পাহাড়ি জঙ্গলে পথ হারিয়ে

লেখক: নুরুল করিম রাসেল
প্রকাশ: ৪ years ago

ফেরদৌস জামান : পাহাড় পর্বতে ভ্রমণ মানে পরিশ্রম। পরিশ্রমের পর খাবার হিসেবে যেটাই পাওয়া যায় অমৃত মনে হয়। রাতের খাবারে ভাতের সঙ্গে থাকলো মারফা এবং কাঁকড়ার ঝোল। চন্দ্রের রান্নার হাত মন্দ নয়। কামাত্রি নামক এক ধরনের ডাটার সঙ্গে শুঁটকি দিয়ে চটজলদি রান্না করে ফেললো দারুণ স্বাদের তরকারি। পেট ভরে ভাত খাওয়ার পর কারবারির ইতিবাচক সিদ্ধান্ত শুনে প্রত্যেকের মনের মধ্যে ফুরফুরে অনুভূতি।

ঘরের বড় মেঝেতে একেকজন হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। কথাবার্তার শব্দে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলো। জেগে দেখি সবে ভোরের আলো ফুটে বেরোচ্ছে। আমাদের থেকে একটু তফাতে কারবারি আর চন্দ্রের মধ্যে কথাবার্তা চলমান। চন্দ্রের চেহারা ঠিকমতো দেখা গেল না, তবে কথায় চরম হতাশার সুর। একে একে সকলেই জেগে উঠল। কারবারি জানিয়ে দিলেন যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। শুধু তাই নয়, তার কথার মধ্যে আর একটা স্পষ্ট আভাস পাওয়া গেল, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাদের পাড়া ত্যাগ করতে হবে। মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে যে উচ্ছ্বাস নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম তা নিমিষেই তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়লো। পরিকল্পনা ভেস্তে যাওয়ায় আমরা যতটা না কষ্ট পেলাম তার চেয়ে বেশি কষ্ট চন্দ্রের চোখেমুখে। তার মুখে কোনো কথা নেই- সব দোষ যেন তার।

দালি ঝিরিতে ফিরে চায়ের আয়োজন চলমান। এই সময়টুকুর মধ্যে জগত এবং নপা ঝিরির ভাটিতে গিয়ে দশ মিনিট পর ফিরে এসে বললো, এ পথেই নিচে যাওয়া যাবে। তাছাড়া ঝিরিটা খুব সুন্দর! মাঝে দুই একটা ঝরনাও পাওয়া যেতে পারে। ঠিকই তাই, কিছুটা পথ এগিয়ে পথ রোধ করে দাঁড়াল ছোট একটা ঝরনা। লতা ঝুলে একে একে সকলেই নিচে নেমে পড়লাম। আমরা তখনও জানি না যতই সামনের দিকে যাচ্ছি একই পথে ফিরে আসার সম্ভাবনা ততোই অনিশ্চিত হয়ে উঠছে। কিছুদূর পর ঝিরি আরও এক ধাপ নিচে নেমে গিয়েছে কিন্তু নিচে নেমে যাওয়ার জন্য লতা নেই। থাকলেও অতটা গভীরে লতা ঝুলে নামা অসম্ভব। চারদিকে ঘন জঙ্গল আর শিকড়ের রাজত্ব, কখনও কোনো মানুষের পা পড়েছে বলে মনে হলো না। পাশ দিয়ে সামান্য উপরের দিকে উঠে ঝরনার পূর্ণ রূপ দৃশ্যমান হলো। নিচে পতনভূমির পাশে কিছু পাথরের বিন্যাস। তাতে বসে কিছুটা সময় অতিবাহিত করতে পারলে মন্দ হতো না! তার জন্য আরও খানিকটা উপরে উঠে যেতে হলো। তারপর নিচে নামার পালা, নামতে হবে শিকড় আর হেলে পড়া ডালপালায় ভর দিয়ে। নামতে গিয়ে দেখা গেল ফাঁকফোকড় দিয়ে নিজের শরীরটা চালান করে দিতে পারলেও পিঠের ব্যাগ বারবার আটকে যাচ্ছে। গাছে ঝুলে থেকেই পিঠ থেকে ব্যাগ খুলে নিচে ছেড়ে দিলাম। বিলক্ষণ তখনও কারও মাথায় একটা কথা খেলছে না যে, একই পথে ফিরে আসার সমস্ত নিশ্চয়তা প্রায় শেষ।

ঝরনার গোড়ায় যাওয়ার পর একরূপ অবরুদ্ধ হয়ে পড়লাম। সামনে খাড়া একটা খাঁদ। কীভাবে নিস্তার মিলবে সে ভাবনা দূরে থাক, উল্টো মনের মধ্যে এক ধরনের সুখকর রোমাঞ্চ খেলে গেলো। পানির ধারা সামান্য বাঁক নিয়ে ডান দিকে চলে গিয়েছে। নূর ভাই একবার দেখে আসতে চান সামনের কী অবস্থা। চন্দ্র আর নপাকে নিয়ে এগিয়ে গেলেন। কয়েক মিনিট পর ফিরে এলেন দুচোখ ভরা স্বার্থকতার তৃপ্তি নিয়ে। খুব করে একবার গিয়ে দেখে আসতে বললেন- কীভাবে ঢালু দেয়ালের গা বেয়ে শত ফুট নিচে পানি গড়িয়ে নামছে।

অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিলাম, বাম পাশ দিয়ে এগিয়ে আবারও উপরের দিকে উঠে মূল ট্রেইলে ফেরার চেষ্টা করব। খাঁদের ধার দিয়ে শুধু পা রাখার মতো কয়েকটা পথর বের হয়ে আছে। তার উপরে ঝুলছে শিকড় আর কিছু লতা। শিকড়, লতা আর পাথরকে অবলম্বন করে কোনমতে জায়গাটা পার হতে পারলেও শুরু হলো বৃষ্টি। এমন অবস্থায় উপরে ওঠা দূরের কথা, নিচে নামাও কঠিন হয়ে পড়ল। কোনো পথ নেই শুধু আন্দাজের উপর নামতে থাকলাম। নূর ভাই এবং চন্দ্র সামনে, পিছনে আমার সঙ্গে শরিফ ভাই। দুই পথপ্রদর্শকের মধ্যে একজনের গলা কিছুক্ষণ ভালোই শোনা গেল। তারপর কখন যে জঙ্গলে হারিয়ে গেল টের পেলাম না। শুধু চন্দ্রের ভরসায় এগোতে থাকলাম।

বিষম ঢালু পাহাড়, পানির স্পর্শে কাদা মারাত্মক আকার ধারণ করল। গাছ অথবা শিকড় আঁকড়ে না ধরে এক পা নিচে নামা সম্ভব না। একটা পর্যায়ে প্রবেশ করলাম বাঁশের ঘন জঙ্গলে। পরপর দুইটা সাপ দেখার পর পা আর উঠতে চাইল না। চিৎকার করে ডাকাডাকির পরও লিনি এবং নপার কোনো সাড়া নেই। শ্বাসরুদ্ধকর পথের পর এমন একটা জায়গায় উপস্থিত হলাম, যেখান থেকে নিচে নামা প্রায় অসম্ভব। পনেরো ফুট উঁচু আস্ত পাথরের একটা দেয়াল আর তার উপর দাঁড়ানো আমরা চারজন নিরুপায় পথিক। দেয়ালজুড়ে লতানো গাছের পুরু আচ্ছাদন। লতায় ঝুলে কোনোমতে নিচে নামতে হলো। একেকজনের ঝুলে নামা আর ছিঁড়ে পড়ার দৃশ্য সকলের জন্য প্রচণ্ড হাসির খোরাক হলো।

কিন্তু এবার শরীর যেন ছেড়ে দিলো। অথচ বসে থাকলে চলবে না। তাই আবারও পথে পা বাড়ালাম। খানিক নেমেই পেয়ে গেলাম একটা ঝিরি। ঝিরিই পৌঁছে দিলো আমাদের দুই সোনার টুকরো পথপ্রদর্শকের কাছে। বেচারা দুজন পাথরের উপর বসে আরামসে বিড়ি টানছে। সামান্য বিশ্রাম ও খাবারের পর ঝিরি থেকে বেরিয়ে জুমের পথ ধরে এগোতে থাকলাম এবং উঠে গেলাম বেশ উঁচুতে। পেছন ফিরে তাকালে দৃষ্টি আটকে গেল খানিক আগে ফেলে আসা সেই জলপ্রপাতে গিয়ে, যেখানে দালি ঝিরি ঢেলে দিচ্ছে তার হৃদয় নিংড়ানো সমস্ত জল। চারপাশে নব যৌবনা সবুজ, ঠিক তার মাঝখানের ধূসর দেয়াল বেয়ে অবিরাম গড়িয়ে পড়ছে শুভ্র জলের ধারা। কি তার নামধাম, কি তার পরিচয় কিংবা আদৌ তার কোনো নাম আছে কিনা সে বিষয়ে কিছুই জানতে পারলাম না।

নপাকে তার পাড়ায় রেখে যখন লাই পাড়ার আগে জুমটাতে পৌঁছলাম তখন শরীর যেন আর চালিয়ে নিতে পারছিলাম না। কয়েকজন আগন্তুকের উপস্থিতি টের পেয়ে জুমের মালিক খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এগিয়ে এলেন। একেক জনের কাহিল অবস্থা দেখার পর কথা না বাড়িয়ে প্রথমে ঘর থেকে কয়েকটা কলা বের করে দিলেন। তারপর একইভাবে ফিরে গেলেন ক্ষেতের দিকে। কিছুক্ষণ পর শসা, মারফা এবং চিনাগুলা নামে এক প্রকার ফল নিয়ে স্বস্ত্রীক ফিরে এলেন। এত রকমের ফল খেয়ে তাদের কাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হলো। কারণ রাতে আমরা তাদের বাড়ির অতিথি। সন্ধ্যা থেকে শুরু করে রাত প্রায় আটটা পর্যন্ত চললো রান্নাবান্না এবং গল্পের আসর। তারপর পরিবারের সবাই একসঙ্গে বসে খাওয়ার পর শুয়ে পড়লাম।

ভোরে ঘুম থেকে জেগে দেখি লোকটি নিজেই আমাদের জন্য খাবার রান্না করছেন। কাচকলার তরকারি, সাথে গরম ভাত। তার কথা, অতিথিকে না খাইয়ে সকাল সকাল বিদায় হতে দেবেন না। আগের রাতেও মুরগির মাংসের তরকারি দিয়ে জমপেশ খাইয়েছেন। এমন আন্তরিকতার পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিদানের কথা ভাবতে গিয়ে রীতিমত অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম। তবুও চন্দ্রের হাত দিয়ে তাকে কিছু অর্থ দেয়ার ব্যবস্থা করলাম। তিনি যেন আমাদের জন্য আরও কিছু সেবা করতে চাইলেন। ডান পায়ে সামান্য সমস্যার কারণে তাকে লাঠিতে ভর দিয়ে হাঁটাচলা করতে হয়। দীর্ঘ দিন ধরে ব্যবহারের ফলে বেঁতের লাঠিটা কালো এবং ঝকঝকে হয়ে গিয়েছে। বিদায়ের সময় শরিফ ভাইয়ের হাতে তুলে দিয়ে বললেন, কঠিন পথ কাজে দেবে।

দুপুরের পরপর ফিরে এলাম লিনির জুমে। সোনা রং ঝরে পড়ছে ধান ক্ষেতের পরতে পরতে। তার মাঝে লিনির পরিবারের সকল সদস্য পিঠে একটা করে থুরং নিয়ে ফসল সংগ্রহে ব্যস্ত। ঘরের মাচায় খেলা করছে চার-পাঁচটা শিশু এবং একটা কুকুর। আমাকে দেখা মাত্র লিনির বড় ছেলে চটজলদি কয়েকটা কঁচি ভুট্টা ছিড়ে এনে সিদ্ধ তুলে দিলো। সিদ্ধ ভুট্টা পাহাড়ি পথে সর্বোত্তম খাদ্য। পেট ভরে খেয়ে লম্বা বিশ্রাম। তারপর আবারও পথে পা বাড়ালাম। জুমের মাঝ দিয়ে পথ আস্তে আস্তে উঠে গেল পাহাড়ের শীর্ষদেশে। পথ ফুরালো হাঁসুলি বাঁকের মাথার উপর গিয়ে। নিচে নামলেই খদপাড়া। কাইদার ঘরে ফিরে মনে হলো নিজ বাড়িতে ফিরলাম। গোসল এবং প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে বের হলে বাচ্চাকাচ্চাসহ পিছু নিলো একদল শূকর। মানববর্জ্য তাদের প্রিয় খাদ্য। কর্ম শেষে স্থান ত্যাগ করার আগেই কাছে এসে ঘুরঘুর করতে থাকে। সুতরাং, হাতে একটা লাঠি না থাকলেও ক্রিকেট খেলার অভিজ্ঞতাটা খুব জরুরি। নিজ জায়গা থেকে অনবরত ঢিল ছুড়তে পারলে তবেই না রক্ষা। খালের বুকজুড়ে পাথরের অপরূপ বিন্যাস। ঠিক তার মাঝখান দিয়ে বয়ে গিয়েছে বর্ষার আহ্লাদি স্রোতধারা। এক পর্ব ডুবসাঁতার আবার এক প্রস্থ গল্পগুজব, এমনি করে পাহাড়ের বুকে নামিয়ে আনলাম বিষাদে নিবিড় গোধূলি বেলা।

ঘরে ফিরে দেখি রান্না শুরু হয়ে গিয়েছে। কিশোরীর পায়ের মচমচ শব্দ ঘরের এপাশ থেকে ওপাশ করছে। দূরবর্তী বাজার থেকে থুরং ভর্তি বাজার নিয়ে ফিরে এল কাইদার দুই ছেলে। শিশুদের জন্য চিপস্, বিস্কুট আর আম-কলা আকৃতির হলুদ রঙের ছোট ছোট জুসপ্যাক। শুরু হলো ঘরশুদ্ধ দৌড়াদৌড়ি। খুশিতে আত্মহারা শিশুরা দেখিয়ে দেখিয়ে খেয়ে চললো সাধের খাবার। ওদিকে রাতের খাবার হিসেবে নানান পদের সাথে যুক্ত হয়েছে কাঁকড়ার ঝোল এবং শামুক। বসতির তরুণরা দেখতে এলো- কারা এসেছে? তাদের মধ্যে একজন সঙ্গে এনেছে কিছু সিদ্ধ ভুট্টা। ভাত খেয়ে সামান্য বিরতির পর ভুট্টা খাওয়া তাদের অভ্যাস। সামনে এনে বললো- দাদা খাবেন? মনে মনে ভাবলাম, এমন ভালোবাসার দান ফিরিয়ে দেয়ার সাধ্য কি আমার আছে? ভুট্টা খেতে খেতে আগত তরুণদল এবং কাইদার পরিবারের সকল সদস্যের সাথে অতিবাহিত হলো এক মনোজ্ঞ সময়।

শেষ রাতে আবারও সেই মচমচ শব্দ। ঘরের এপাশ থেকে ওপাশ করতে থাকলো। শব্দটা ভীষণ অপ্রিয় বলে মনে হতে লাগলো। কেন হলো তা জানি না। শুধু মনে হলো, শব্দ হলেই ঘুম ভাঙবে। আর ঘুম ভাঙলেই চলে যেতে হবে! খালের মন জুড়ানো কুলকুল শব্দ সবাইকে ঘুমের দেশে নিয়ে যায় আর কিশোরীর ঘুম ভাঙায়। খালের ধারা বয়ে যায় দূরে, সীমাহীন দূরত্বে। কিন্তু কিশোরীর সারাটা জীবন ঘুরপাক খায় পাহাড়ের পেটের মধ্যে। (শেষ)