ঈদের ছুটিতে দেশ বিদেশি পর্যটক দর্শনার্থী বরণে প্রস্তুত মেগাউন্নয়নে পাল্টে যাওয়া ডুলাহাজারা বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক

: হুমায়ুন রশিদ
প্রকাশ: ৬ মাস আগে

এম জিয়াবুল হক : রোজার ঈদের টানা ছুটিতে দেশ বিদেশি পর্যটক দর্শনার্থী বরণে অপরুপ সৌন্দর্যের পসরা সাজিয়ে প্রস্তুত রয়েছেন দেশের প্রথম কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার ডুলাহাজারা বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক।

প্রতিষ্ঠার দুইযুগ পর সরকারের মেগাউন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় পার্কের ইতোমধ্যে পার্কের ভেতরে বাইরের পর্যটন স্পটগুলোকে নতুনভাবে টেকসই উন্নয়ন কাজের বিপরীতে বদলে দেওয়া হয়েছে। তাতে নান্দনিক পরিবেশে অত্যাধুনিক রূপ ফিরে পেয়েছে ডুলাহাজারা বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক। নতুন খাঁচায় শোভা পাচ্ছে সবধরনের প্রাণীকূল। মানবপ্রেমেই আচ্ছন্ন বাঘ-সিংহ-হাতি-হরিণ-জেব্রা দেখে আনন্দিত হচ্ছেন পার্কে আগত দর্শনার্থী আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা।

সরেজমিনে দেখা গেছে, কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়ক থেকে পার্কে প্রবেশপথের মূল গেট পর্যন্ত এলাকার আশপাশে কয়েকবছর আগে বেদখল বনভূমি উদ্ধার করে তৈরি হয়েছে বাস-মাইক্রো ও মোটরসাইকেল সহ যানবাহনের সুপরিসর পার্কিং।

সাফারি পার্কের বাইরে পার্কিং এলাকা লাগোয়া পূর্বপাশেই সাদা উড়ন্ত পায়রা হাতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ম্যুরালের চারপাশে গড়া হয়েছে সবুজের আবরণ, সাজানো ফুল বাগান। পার্কের দক্ষিণে গড়ে তোলা হয়েছে পিকনিক স্পট, শিশু বিনোদন কেন্দ্র। এরই দক্ষিণে পাহাড়ের পাদদেশে চলমান আছে কৃত্রিম লেক গড়ার কাজ।

মেগাউন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় পার্কের প্রবেশপথের পুরানো ফটক ভেঙে দৃষ্টিনন্দন করে তৈরি করা হয়েছে নতুন প্রবেশ ফটক। প্রশস্ত করা দু’পাশের দুই লেনের সড়কের ফুটপাতে বসেছে টাইলস। গোছালো সুপরিসর টিকিট ঘর, পর্যটকদের লাগেজ ও প্রয়োজনীয় মালামাল রাখার লকার রুম হয়েছে। সাথে তৈরি হয়েছে ব্রেস্টফিডিং ও দর্শনার্থী অপেক্ষা কক্ষও।

ইতোমধ্যে তিনটি অর্থবছরে উন্নয়ন কাজের অংশে সংস্কার হয়ে নতুনত্ব পেয়েছে ডরমেটরি ও ব্যারাক। আধুনিক মানের ওয়াশরুমে প্রফুল্ল দর্শণার্থীরা। সংস্কার হয়েছে পার্কের মাঝখানের শতাধিক ফুট উঁচু ওয়াচ টাওয়ার। চলমান আছে বাচ্চাদের বিনোদনে আলাদা অ্যামিউজিং পার্ক ও পার্কে দর্শনার্থী প্রবেশ-বাহির পথ তৈরির কাজ।

জানা গেছে, কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার ডুলাহাজারা ইউনিয়নের মালুমঘাট এলাকায় ১৯৯৯ সালে যাত্রা শুরু হয় ডুলাহাজারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কের। এর আগে ১৯৮০ সালে এটি ছিল হরিণ প্রজননকেন্দ্র। ভেতর-বাইরে সরকারি বনাঞ্চলের ৯০০ হেক্টর আয়তনের জায়গা নিয়ে গড়ে তোলা পার্কে বিপুল পরিমাণ মাদার ট্রিসহ (গর্জন) আছে নানা প্রজাতির বনজ গাছ সমৃদ্ধ সবুজ অরণ্য।
সবুজের আবরণে দৃষ্টিনন্দন পার্কটি শুরু থেকেই প্রকৃতিপ্রেমী মানুষের বিনোদনের অনুষঙ্গ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। শিক্ষার্থীরা এই পার্ক থেকে প্রকৃতিবিষয়ক জ্ঞান আহরণ করতে পারে। সপ্তাহের মঙ্গলবার ছাড়া বাকি ছয়দিন দর্শনার্থীদের উচ্ছ্বাসে, প্রাণীকূলের কোলাহলে মুখরিত হয়ে ওঠে পুরো পার্ক।

প্রাপ্তবয়স্করা ৫০ টাকা আর ৫ বছরের বড় শিশু-কিশোররা ৩০ টাকায় ও শিক্ষার্থী (শর্তসাপেক্ষে) ১০০ জনে ৫০০ টাকা ও ২০০ জন ৮০০ টাকার টিকিটে পার্ক দর্শন করতে পারছেন। দর্শণার্থীরা চাইলে নির্ধারিত ফি দিয়ে কর্তৃপক্ষের নিজস্ব মিনিবাসে করে সাফারি পার্ক ঘুরে দেখতে পারেন।

কক্সবাজার শহর থেকে ৫০ কিলোমিটার উত্তরে চকরিয়া উপজেলার ডুলাহাজারায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কের অবস্থান। শতবর্ষী গর্জন বনের ভেতরে লোহার বেষ্টনীতে সুন্দর ও শ্রুতিমধুর নামে বাস করছে একেকটি প্রাণী।

তথ্যমতে, পার্কে দেড় ডজন বেষ্টনীতে সংরক্ষিত প্রাণীকূলে কঠোর নিরাপত্তায় পালিত হচ্ছে হাতি, বাঘ, সিংহ, জলহস্তি, গয়াল, আফ্রিকান জেব্রা, ওয়াইল্ডবিস্ট, ভাল্লুক, বন্য শূকর, হনুমান, ময়ূর, স্বাদু ও নোনা পানির কুমির, সাপ, বনগরুসহ দেশি-বিদেশি নানা প্রজাতির প্রাণী।

পার্কজুড়ে আরও আছে চিত্রা, মায়া, সম্বর ও প্যারা হরিণ। আছে জানা-অজানা বিচিত্র ধরনের কয়েকশ’ ধরনের পাখি। ৫২ প্রজাতির ৩৫০ প্রাণী পার্কে দেখা মেলে।

উন্মুক্তভাবে আছে ১২৩ প্রজাতির এক হাজার ৬৫ প্রাণী। এর মধ্যে গুইসাপ, শজারু, বাগডাশ, মার্বেল ক্যাট, গোল্ডেন ক্যাট, ফিশিং ক্যাট, খেঁকশিয়াল, বনরুই উল্লেখযোগ্য। হেঁটে পার্ক ভ্রমণের সময় অসংখ্য বানর, শিয়াল, খরগোশ, হরিণসহ বন্যপ্রাণীর দৌড়ঝাঁপ দেখা যায়।

দেখা মেলে কালের সাক্ষী বিশালাকার দুর্লভ ও মূল্যবান বৃক্ষরাজির। সেসব গাছ ও দেয়ালে দেয়ালে বানরের লাফালাফি নজর কাড়ে সবার। এসব দৃশ্য মোবাইল ফোন ক্যামেরায় বন্দি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন দর্শনার্থীরা।

পার্কের প্রাণীকূলের চিকিৎসার জন্য রয়েছে নিজস্ব হাসপাতাল। যেখানে সার্বক্ষণিক রয়েছে প্রাণী চিকিৎসক। প্রতিদিন সাফারি পার্ক ভ্রমণে আসা দর্শনার্থীদের মূল আকর্ষণ থাকে বাঘের বেষ্টনী। বাঘের দৌড়ঝাঁপ দেখে সবাই আনন্দে থাকেন মাতোয়ারা।

পার্কের বাঘ-সিংহ ও তৃণভোজী প্রাণীদের জন্য তৈরির শেষ পর্যায়ে রয়েছে সাফারি। বাঘ-সিংহের জন্য শত একর জমির আলাদা সাফারি ও জেব্রা, গয়াল, হরিণসহ অন্যপ্রাণীদের জন্য বরাদ্দ হয়েছে কয়েকশ’ একর এলাকা।

বেষ্টনী অনুসারে সাফারির চারপাশে তৈরি হয়েছে নিরাপদ পরিদর্শন ও পর্যবেক্ষণ পথ। গড়া হয়েছে প্রবেশ-বাহিরের জন্য স্বয়ংক্রিয় ফটক, যান চলাচলে উপযুক্ত পাকা সড়কও। বাঘ-সিংহসহ হিংস্র প্রাণী বনে মুক্ত করে দেওয়া হলে খাঁচাযুক্ত গাড়িতে করে দর্শনাথীর্রা বেষ্টনীতে ঢুকে বিচরণরত বাঘ-সিংহ অবলোকন করেন।

চকরিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সাফারি পার্কের ইজারাদার ফজলুল করিম সাঈদি বলেন, ঈদ ও নানা আয়োজনে স্থানীয় জনগণের বিনোদনার্থে হাতের কাছে পার্কটি আমাদের ভরসা হয়ে উঠেছে। দীর্ঘ সময় পার্কে কোনধরনের উন্নয়ন কাজ হয়নি। তবে গত তিনটি অর্থবছরে মেগাউন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় বাস্তবায়ন করা উন্নয়ন কাজের ফলে পার্কের পুরোনো চিত্র বদলে গেছে।

জানা গেছে, আবদ্ধ ও উন্মুক্ত প্রাণি এক বেষ্টনী হতে অন্য বেষ্টনী পর্যন্ত সহজে যেতে তৈরি হয়েছে সংযোগ সড়ক। অতিরোদ পড়া বেষ্টনীগুলো ছায়া ঘেরা পরিবেশে স্থানান্তর করা হয়েছে। তৈরি হয়েছে সুনিপুণ অবকাঠামো। এখন সহজে বিশাল পার্কে ঘোরা যায়।

ডুলাহাজারা সাফারি পার্কের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (রেঞ্জ অফিসার) মো. মাজহারুল ইসলাম বলেন, প্রতিষ্ঠার দুই যুগে এসে ডুলাহাজারা সাফারি পার্ক এই অঞ্চলের মানুষের বেড়ানো ও বিনোদনের অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিবছর রোজার ঈদ ও কোরবানির ঈদের পাশাপাশি এখানে বার্ষিক পিকনিক করতে আসছে অনেক শিক্ষা ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান। গুরুত্ব বিবেচনা করে সরকারের বিশেষ প্রকল্পের আওতায় ইতোমধ্যে পার্কের বিভিন্ন পর্যটন স্পটগুলোর অবকাঠামোগত উন্নয়ন করা হয়েছে।

তিনি বলেন, সাফারি পার্কের অতীব ‘প্রয়োজনীয় অনেক কাজ ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে, কিছু কাজ সমাপ্তের পথে-তাও দ্রুতগতিতে এগুচ্ছে। চলতি অর্থবছরের শেষের দিকে আমরা সে লক্ষ্য ছুঁতে পারব বলে আশা করছি।’
রেঞ্জ অফিসার মাজহারুল ইসলাম আরও বলেন, এবারের রোজার ঈদে দেশ বিদেশি পর্যটক দর্শনার্থী আগমন নিশ্চিত করতে আমরা সাফারি পার্ককে নতুনভাবে ঢেলে সাজিয়েছি। আশাকরি ঈদের ছুটিতে দর্শনার্থীরা সাফারি পার্ক দর্শনে এসে ভালো কিছু উপভোগ করতে পারবেন। ##