খাঁন মাহমুদ আইউব : টেকনাফ স্থলবন্দরের যাতাকলে পৃষ্ট ব্যবসায়ীরা। শুরু থেকে বন্দরে সেবার নামে চলছে ব্যবসায়ীদের সাথে প্রহসন। আধুনিক সুযোগ সুবিধা ও পণ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিতসহ নেই কোন অবকাঠামোগত উন্নয়ন। দফায় দফায় ব্যবসায়ীরা অসুবিধার কথা জানালেও নিয়ম নীতির ধারধারেনা কর্তৃপক্ষ। লোকসানের মুখে পড়ে বন্দর বিমুখ হয়ে ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে অনেক ব্যবসায়ীরা। ফলে সরকার হারাচ্ছে শত কোটি টাকা রাজস্ব।
বাংলাদেশ মিয়ানমার দুই দেশের সীমান্ত চোরাচালান বন্ধ করার লক্ষ্যে ১৯৯৫ সালের ৫ সেপ্টেম্বর সীমান্ত বাণিজ্যের যাত্রা শুরু। পরে ২০০৩ সালে এটি স্থল বন্দর হিসেবে যাত্রা শুরু করে। পরবর্তিতে ২০১২ সালে ইজারা মাধ্যমে ইউনাইটেড ল্যান্ড পোর্ট লিঃ নামের একটি প্রতিষ্টানকে ২৫ বছরের জন্য পরিচালনার দায়ীত্ব দেয় নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়। প্রতিষ্ঠানটি দায়িত্ব নেওয়ার পর ৭ একর জমির উপর নির্মিত বন্দরটির আয়তন ২০ একর বাড়িয়ে বর্তমানে ২৭ একর করা হলেও আমদানি-রপ্তানি প্রক্রিয়ায় অনেকটা উদাসিন প্রতিষ্ঠানটি।
অমদানীকারকদের অভিযোগ, বছরের পর বছর একটি গেইটে দুইটি স্কেল বসিয়ে একই গেইট দিয়ে প্রবেশ এবং বাহির করে কৃত্রিম যানজট সৃষ্টি করে রেখেছে। এই কৃত্রিম যানজটের কারনে পণ্যবোঝাই গাড়ী বন্দরের অভ্যান্তরে দাঁড় করে রাখতে হয়। সেই ক্ষেত্রে তাদের অব্যবস্থাপনা দায়ী হলেও ব্যবসায়ীদের রীতি মতো বন্দরের ভাড়া গুনতে হয়। অতচ অপর পাশে গেইটসহ বিশাল খালি জায়গা পরিত্যাক্ত ভাবে ফেলে রেখেছে। একটু বৃষ্টি হলে পণ্য খালাস বা বোঝাই করাতো দূরের কথা, কাদাতে হাটা চলাও দ্বায় হয়ে পড়ে।
ফারুক ট্রেডার্সের সত্ত্বাধিকারী ওমর ফারুক জানান, বন্দরে সারা দিন রোদ বৃষ্টিতে ব্যবসায়ীদের অবস্থানের কোন শেড নেই। দ্বীর্ঘ জেটির উপর কোন ছাউনি না থাকায় বৃষ্টিতে কাঁচা পণ্য ট্রলার থেকে ওয়্যারহাউজে আনার সময় নষ্ট হয়ে যায়। তাছাড়া বন্দরে কমপক্ষে ৮টি জেটি থাকা প্রয়োজন। সেখানে মাত্র ৩টি জেটির মধ্যে ব্যবহার হচ্ছে ২টি। জেটি সংকটের কথা বারবার কর্তৃপক্ষকে বলার পরেও উপায় না দেখে কয়েকজন ব্যবসায়ী নিজেদের অর্থায়নে ৪টি কাঠের জেটি নির্মান করেছে। এছাড়াও দুটি ওয়্যার হাউজের মধ্যে একটি স্বচল অপরটি বন্ধ। ওয়্যারহাউজে জায়গা সংকটের কারনে পণ্য বন্দরের খোলা মাঠে স্তুপ করে রাখতে হয়। এতে বিভিন্ন সময় পণ্য বৃষ্টিতে ভিজে গেলে বা চুরি হলেও বন্দর কর্তৃপক্ষ এর দায় নেয় না। এসব সমস্যার কারনে ব্যবসা গুটিনেয়ার কথ ভাবছি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক আমদানীকারক বলেন- দেশের প্রতিটি বন্দরে স্ক্যানার থাকলেও এই বন্দরে নেই কোন স্ক্যানার। তাছাড়া বন্দরে ৩শ টন ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন একটি কোল্ড স্টোরেজ থাকলেও তা অচল। তবে কোল্ড স্টোরের নামে চার্জ আদায় করে কাঁচা পন্য গুলো যেখানে রাখা হয় সেখানে একজন মানুষ টানা ২৪ ঘন্টা অবস্থান করলে সেদ্ধ হয়ে যাবে। এতে পণ্য পঁচে মারাত্বক ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে ব্যবসায়ীরা। তা ছাড়া এই স্টোরেজ থেকে পণ্য চুরি হয় নিয়মিত। বন্দর কর্তৃপক্ষকে জানালেও কোন প্রতিকার মেলেনা। এসব কারনে বহিরাঞ্চল থেকে আসা কয়েকজন ব্যবসায়ি ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে।
লেবারের মাঝি আজগর জানান, গড়ে সাড়ে ৫ শতাধিক শ্রমিক বন্দরে কাজ করে। তাদের জন্য বন্দরে কোন সৌচাগার নেই। শেডের অভাবে সারাদিন পরিশ্রম করে অমানবিক ভাবে খোলা মাঠে রোদ-বৃষ্টিতে ভিজে খাবার খেতে হয়। বন্দরে নেই কোন সুপেয় পানির ব্যবস্থাও। অনেক সময় পাহাড়ি ছড়ার পানি পান করে অসুস্থ হয়ে যায় শ্রমিকরা। কোন দূর্ঘটনা হলে জরুরী প্রয়োজনে তাদের প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য বন্দরে নেই কোন চিকিৎসা ব্যবস্থা।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে কিছু অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করে বন্দরের ডিজিএম জসিম বলেন- যানজটের বিষয়টি ব্যবসায়ীদের অসহযোগীতার কারনে হচ্ছে। নিরাপত্তাজনিত কারণে অপর গেইটটি উন্মুক্ত ও হাসপালের বৈর্জ্য ব্যবস্থাপনার সুযোগ না থাকায় হাসপাতালটি করা যাচ্ছেনা। তবে স্ক্যানারের বিষয়টি নৌপরিবহন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ে জানানো হয়েছে। পণ্য চুরির বিষয়টি উড়িয়েদেন তিনি।
সর্বশেষ গেলো ২৩ জুন টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পারভেজ চৌধুরীর সভাপতিত্বে বন্দরের বিরুদ্ধে ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন অভিযোগের ভিত্তিতে এক সভায় তোপের মুখে পড়েন বন্দরের এই কর্মকর্তা।
স্থল বন্দর ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক এহতেশামুল হক বাহাদুর বন্দর ম্যানেজার জসিমের বক্তব্যের বিরোধীতা করে তাকে মিথ্যুক অখ্যায়িত করে বলেন- বন্দর কর্তৃপক্ষকে শুরু থেকে বন্দরের নিরাপত্তা ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের কথা বলা হলে তারা আশ্বাসের বাণীতে সীমাবদ্ধ। ব্যবসায়ীদের রক্ত চোষে খাচ্ছে কিন্তু ব্যবসায়ীদের কোন সুযোগ সুবিধা দিচ্ছেনা। মাত্র হাতেগুনা ৭/৮ জন লোক দিয়ে গোটা বন্দর পরিচালনা করছে। নাইট চার্জ নিলেও রাত ৯টার পরে বন্দরের কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়। এভাবে হলে অচিরেই বন্দর ব্যবসায়ী শুন্য হয়ে পড়বে।
কাঠ ব্যবসায়ীরা জানান, আমদানীকৃত কাঠ গুলো আকারে বড় এবং ওজনে অধিক ভারী। এই কাঠগুলো ট্রলার থেকে খালাসের কোন ক্রেং নেই। বিগত সময়ে একটি ক্রেং এনেছিলো সেটি ট্রলার থেকে কাঠ খালাসকালে নদীতে পড়ে গিয়ে কয়েক জন শ্রমিক আহত হয়েছে। তাছাড়া জীবন ঝুঁকি নিয়ে ট্রলার থেকে কাঠ খালাস করতে গিয়ে এই পর্যন্ত তিনজন শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে।

স্থল বন্দর পরিচালনা কমিটির সভাপতি টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পারভেজ চৌধুরী বলেন- বন্দরে অবকাঠামোগত অনেক সমস্যা রয়েছে। এসব বিষয়ে বন্দর কর্তৃপক্ষের সাথে কথা হয়েছে। তারা এসব কাজ সম্পন্ন করার কথা দিয়েছেন। অন্যথায় তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, এভাবে চলতে থাকলে সম্ভাবনাময় এই স্থল বন্দরটি থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়া ছাড়া কোন উপায় থাকবে না। আর তা যদি হয় তবে বছরে প্রায় হাজার কোটি টাকা রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হবে সরকার। ব্যবসায়ীদের দাবি, বিশাল বাণিজ্য সম্ভাবনার এই বন্দরকে আমদানি-রপ্তানির জন্য উপযুক্ত করে গড়ে তুলে দেশের অর্থনৈতিক গতিশীল করা দরকার।
