মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ : শ্রম অধিকারের বিষয়ে ইসলাম যে রূপরেখা দিয়েছে তা কিয়ামাত পর্যন্ত শ্রেষ্ঠত্বের আসনে থাকবে। ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা শ্রমিকের শরীরের ঘাম শুকানোর আগেই তার পারিশ্রমিক দিয়ে দেবে।’ (ইবনে মাজাহ) শ্রমিকের পারিশ্রমিক নির্ধারণ না করে তাকে কাজে নিযুক্ত করতে রাসুল (সা.) স্পষ্ট ভাষায় নিষেধ করেছেন। (সহিহ বুখারি)
ইসলামের দৃষ্টিতে সম্পদের সার্বভৌমত্ব ও মালিকানা আল্লাহর, আর মানুষ তার তত্ত্বাবধায়ক মাত্র। সুতরাং এখানে মালিক-শ্রমিক সবাই ভাই ভাই। তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক হবে শ্রদ্ধা, স্নেহ, সৌহার্দ্য ও বিশ্বস্ততায় ভরপুর। শ্রমিক ও মালিক উভয়ের অধিকার রয়েছে নিজ নিজ প্রাপ্য বুঝে পাওয়ার। উভয়কে বলা হয়েছে নিজ নিজ কর্তব্য পালনে দায়িত্বশীল হতে। শুধু মালিক বা শ্রমিক নয়; বরং উভয়কে সুসংহত আচরণ করার নির্দেশ দিয়েছে।
ইসলাম শ্রমের শ্রেণিবিন্যাসকে স্বীকার করলেও মানবিক মূল্যবোধ ও মৌলিক মানবাধিকারের ক্ষেত্রে সবাই সমান। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) মানুষকে ব্যবসা, কৃষি ও দ্বীনচর্চায় উৎসাহিত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘শ্রমজীবী আল্লাহর বন্ধু।’ আর ইসলামে শ্রম, শ্রমিকের মর্যাদা ও অধিকার সম্পর্কে বহু নির্দেশনা রয়েছে। শ্রমের প্রতি উৎসাহ দিয়ে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘অতঃপর যখন নামাজ পূর্ণ করা হবে, তখন জমিনে ছড়িয়ে পড়ো। আর আল্লাহকে অধিক মাত্রায় স্মরণ করো, আশা করা যায় তোমরা সফল হবে।’ (সুরা জুমুআ, আয়াত ১০)
হাদিসে এসেছে, ‘ফরজ ইবাদতগুলোর পরই হালাল উপার্জন করা ফরজ দায়িত্ব।’ (তিরমিজি)। ‘হালাল উপার্জনগুলোর মধ্যে তা সর্বোত্তম, যা কায়িক শ্রম দ্বারা অর্জন করা হয়।’ (সহিহ মুসলিম) শ্রমিকের অধিকার ও শ্রমগ্রহীতার কর্তব্য সম্পর্কে হাদিসে এসেছে, ‘শ্রমিকরা তোমাদেরই ভাই, আল্লাহ তাদের তোমাদের দায়িত্বে অর্পণ করেছেন। আল্লাহ যার ভাইকে তার দায়িত্বে রেখেছেন, সে যা খাবে তাকেও তা খাওয়াবে, সে যা পরিধান করবে তাকেও তা পরিধান করাবে। তাকে এমন কষ্টের কাজ দেবে না যা তার সাধ্যের বাইরে, কোনো কাজ কঠিন হলে সে কাজে তাকে সাহায্য করবে।’ (সহিহ মুসলিম)
হজরত শুআইব (আ.) হজরত মুসা (আ.)-কে কাজে নিয়োগ দেওয়ার সময় বলেছিলেন, ‘আর আমি আপনাকে কষ্টে ফেলতে চাই না। ইনশাআল্লাহ, আপনি আমাকে কল্যাণকামী হিসেবে পাবেন।’ (সুরা কাসাস, আয়াত ২৭) হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘এক লোক এসে রাসুল (সা.)-এর কাছে ভিক্ষা চাইলে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কি কিছুই নেই? সে বলল, আমার একটি কম্বল আছে। রাসুল (সা.) বললেন, যাও কম্বলটি নিয়ে এসো। কম্বল নিয়ে এলে রাসুল (সা.) তা নিলামে বিক্রি করলেন দুই দিরহাম মূল্যে। এক দিরহাম তাকে দিয়ে দিলেন পরিবারের খাবারের ব্যবস্থা করতে। আর এক দিরহাম দিয়ে কুড়াল কিনে রাসুল (সা.) নিজ হাতে তাতে হাতল লাগিয়ে দিলেন। আর ওই লোককে কাঠ কেটে উপার্জন করার নির্দেশ দিলেন।’ (সহিহ বুখারি)
সব নবীই কায়িক পরিশ্রম করে জীবিকা উপার্জন করেছেন। হজরত নুহ (আ.) কাঠমিস্ত্রির কাজ করেছেন। হজরত ইদরিস (আ.) সেলাইয়ের কাজ করতেন। হজরত সুলাইমান (আ.)-এর পিতা হজরত দাউদ (আ.) লৌহশিল্প বা কামারের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। এমনকি হজরত শুয়াইব (আ.)-এর খামারে হজরত মুসা (আ.) প্রায় ১০ বছর চাকরি করেছেন। আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-ও জীবিকা নির্বাহের জন্য কাজ করেছন।
শ্রমিকের ঘাম শুকানোর আগে পারিশ্রমিক দেওয়ার কথা বলা হয়েছে হাদিসে। যারা শ্রমিকের মজুরি দিতে টালবাহানা করে, তাদের ব্যাপারে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘সামর্থ্যবানের জন্য পাওনা পরিশোধে গড়িমসি করা জুলুম বা অবিচার।’ (সহিহ বুখারি) হাদিসে কুদসিতে বর্ণিত হয়েছে, আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘কিয়ামতের দিন আমি তাদের বিরুদ্ধে থাকব, যারা বিশ্বাসঘাতকতা করে, মানুষকে বিক্রি করে এবং ওই ব্যক্তি যে কাউকে কাজে নিয়োগ করল, অতঃপর তার কাজ পুরোটা করল, কিন্তু সে তার ন্যায্য মজুরি দিল না।’ (সহিহ বুখারি) হাদিসে এসেছে, ‘যদি কেউ কারও ন্যায্য পাওনা অস্বীকার করে, আল্লাহতায়ালা তার জন্য বেহেশত হারাম করে দেন।’ (সহিহ মুসলিম)
কোরআন ও হাদিসে শ্রমিকের অধিকার সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি পাওয়া যায়। কিন্তু কথা হচ্ছে আমাদের সমাজে এর বাস্তবায়ন কোথায়? ইসলামের এই কথাগুলো বর্তমানে বহু অমুসলিম দেশে পালনের চেষ্টা করা হয়, কিন্তু মুসলিম প্রধান দেশে এর সামান্যই খুঁজে পাওয়া যায়। আমাদের দেশে দিন দিন মালিক ও শ্রমিকের মধ্যে বৈষম্য বেড়েই চলেছে। কেবল বড় বড় ফ্যাক্টরি ও শিল্পকলকারখানা নয়, বরং ক্ষুদ্র ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং ঘরের কাজের মানুষের ক্ষেত্রেও আমাদের আচরণে পরিবর্তন প্রয়োজন। আল্লাহতায়ালা আমাদের সবাইকে শ্রমিকের সঙ্গে ভালো ব্যবহার এবং তাদের অধিকার আদায়ের তওফিক দান করুন। আমিন।