রমজান মাস ইবাদতের বসন্তকাল

: হুমায়ুন রশিদ
প্রকাশ: ৮ মাস আগে

মুফতি আইয়ুব নাদীম : ইসলামের ভিত্তি পাঁচটি। তার মধ্যে রমজানের রোজা অন্যতম। হিজরি সনের নবম মাস রমজান। ইমান, নামাজ ও জাকাতের পরই রোজার স্থান। রমজান মাস হলো মুমিনের জন্য ইবাদতের বসন্তকাল। বসন্তকালে গাছগাছালি বাহারি পাতায় সেজেগুজে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। আর পশুপাখি ইচ্ছা মতো খেয়ে-দেয়ে তাদের স্বাস্থ্যের উন্নতি করতে পারে। তেমনি মুমিন বান্দা এই মাসে ইবাদত বন্দেগির মাধ্যমে আত্মিক উন্নতি ঘটিয়ে মহান আল্লাহর অধিক নৈকট্য লাভ করতে পারে। আর বছরের অন্যান্য মাসে যেসব ইবাদত পালন করা হয়ে ওঠে না, তা এই মাসে পালন করে সওয়াবের পাল্লা ভারী করা যায়। তা ছাড়া অন্য মাসে যে ইবাদত বন্দেগি করে এক গুণ সওয়াব পাওয়া যায়, রমজান মাসে ওই ইবাদত করে সত্তর গুণ বেশি সওয়াব পাওয়া যায়। রোজার অনেক গুরুত্ব ও নানা ফজিলতের কথা কোরআন ও হাদিসে বর্ণিত হয়েছে।

রোজার পরিচয় : রোজার আরবি শব্দ সাওম। যার আভিধানিক অর্থ বিরত থাকা। পরিভাষায় সাওম হলো, প্রত্যেক মুসলমান, জ্ঞানবান, বালেগ, নর-নারীর সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত রোজার নিয়তে যাবতীয় পানাহার, স্ত্রী সহবাস ও রোজা ভঙ্গ কারী সব কাজ থেকে বিরত থাকা। সুতরাং রমজান মাসের চাঁদ উদিত হলেই প্রত্যেক সুস্থ, মুকিম, প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ এবং রজঃস্রাবমুক্ত প্রাপ্তবয়স্ক নারীর ওপর পূর্ণ রমজানের রোজা রাখা ফরজ।

রোজায় তাকওয়া অর্জন হয় : প্রতিটি আমলের একটি প্রভাব আছে। রোজার প্রভাব সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেন, ‘হে মুমিনরা! তোমাদের প্রতি রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের প্রতি ফরজ করা হয়েছিল, যাতে তোমাদের মধ্যে তাকওয়া সৃষ্টি হয়।’ সুরা বাকারা ১৮৩

রোজার প্রতিদান আল্লাহতায়ালা প্রদান করেন : হজরত আবু হুরায়রা (রা.)-এর সূত্রে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘বনি আদমের প্রতিটি আমলের প্রতিদান বহু গুণে বৃদ্ধি হতে থাকে, ১০ গুণ থেকে ৭০০ গুণ, এমনকি আল্লাহ চাইলে তার চেয়েও বেশি দেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, তবে রোজার বিষয়টি ভিন্ন। কেননা রোজা একমাত্র আমার জন্য এবং আমি স্বয়ং এর প্রতিদান দেব। বান্দা একমাত্র আমার জন্য পানাহার ও প্রবৃত্তির চাহিদা পূরণ থেকে বিরত থাকে। রোজাদারের জন্য দুটি আনন্দ। এক. ইফতারের মুহূর্তে। দুই. রবের সঙ্গে সাক্ষাতের মুহূর্তে। আর রোজাদারের মুখের দুর্গন্ধ মহান আল্লাহর কাছে মেশকের চেয়েও উত্তম।’ সহিহ মুসলিম ১১৫১

রোজাদারের জন্য ক্ষমার পুরস্কার : হজরত আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে-এর বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি ইমানের সঙ্গে সওয়াবের আশায় রমজনের রোজা রাখবে, তার পূর্বের সব গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে।’ সহিহ বুখারি ১৯০১

রোজাদারের সম্মানে জান্নাতে বিশেষ দরজা : হজরত সাহল ইবনে সাদ (রা.)-এর সূত্রে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘জান্নাতে রাইয়ান নামে একটি দরজা আছে। এই দরজা দিয়ে শুধু রোজাদাররা প্রবেশ করবে। ঘোষণা করা হবে, রোজাদাররা কোথায়? তখন তারা উঠে দাঁড়াবে। যখন তারা প্রবেশ করবে তখন ওই দরজা বন্ধ করে দেওয়া হবে এবং সেই দরজা দিয়ে আর কেউ প্রবেশ করবে না।’ সহিহ বুখারি ১৮৯৬

রোজাদারের দোয়া কবুল হয় : হজরত আবু হুরায়রা (রা.)-এর সূত্রে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তিন ব্যক্তির দোয়া ফিরিয়ে দেওয়া হয় না। রোজাদারের দোয়া ইফতার করা পর্যন্ত, ন্যায়পরায়ণ শাসকের দোয়া এবং মজলুমের দোয়া। আল্লাহতায়ালা তাদের দোয়া মেঘমালার ওপরে উঠিয়ে নেন। এর জন্য আসমানের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয়। আর আল্লাহতায়ালা বলেন, আমার ইজ্জতের কসম! বিলম্ব হলেও আমি অবশ্যই তোমাকে সাহায্য করব।’ সুনানে তিরমিজি ৩৫৯৮

রমজান ইবাদতের মাস : হজরত আনাস ইবনে মালিক (রা.)-এর সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, রমজান মাস এলে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলতেন, রমজান মাস তোমাদের মধ্যে উপস্থিত। এ মাসে এমন এক রাত রয়েছে, যা হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। যে ব্যক্তি এ রাতের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হয়, সে সব কল্যাণ থেকেই বঞ্চিত হয়। শুধু হতভাগারাই এ রাতের কল্যাণ হতে বঞ্চিত থাকে।’ (ইবনে মাজাহ ১৬৪৪) বিষয়টি স্পষ্ট যে, এই মাসের এক রাতের ইবাদত সহস্র মাস ইবাদত করা থেকে উত্তম। যে বান্দা এই কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হয়, সে যাবতীয় কল্যাণ থেকেই বঞ্চিত হয়ে যায়।

রোজাদারের সুপারিশ কবুল হয় : হজরত আবদুল্লাহ বিন আমর (রা.)-এর সূত্রে বর্ণিত। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কিয়ামতের দিন রোজা এবং কোরআন বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। রোজা বলবে, হে আমার প্রতিপালক! আমি তাকে পানাহার ও যৌনসম্ভোগ থেকে বিরত রেখেছিলাম। সুতরাং তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ গ্রহণ করুন। আর কোরআন বলবে, আমি তাকে রাতের নিদ্রা থেকে বিরত রেখেছিলাম। সুতরাং তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ গ্রহণ করুন। রাসুল (সা.) বলেন, তাদের উভয়ের সুপারিশ গৃহীত হবে।’ মুসনাদে আহমাদ ৬৬২৬

রোজা অতুলনীয় ইবাদত : হজরত আবু উমামা (রা.) বলেন, ‘আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে এসে বললাম, আপনি আমাকে এমন কিছু নির্দেশ দিন, যা আমি পালন করতে পারব। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, তুমি রোজা আঁকড়ে ধরো। কারণ রোজার সমতুল্য কোনো ইবাদত নেই।’ নাসায়ি ২২২০

রোজায় যৌন ক্ষমতা দমন হয় : হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.)-এর সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে ছিলাম, তিনি বললেন, ‘তোমাদের মধ্যে যে বিবাহের সামর্থ্য রাখে, সে যেন বিবাহ করে। কারণ বিবাহ দৃষ্টি অবনত রাখে, এর মাধ্যমে লজ্জাস্থানের হেফাজত হয়। আর যে ব্যক্তি বিবাহের সমর্থ্য রাখে না, সে যেন রোজা রাখে। কারণ রোজায় যৌন ক্ষমতা দমন হয়।’ সহিহ বুখারি ১৯০৫

রোজা শরীরের জাকাত স্বরূপ : হজরত আবু হুরায়রা (রা.)-এর সূত্রে বর্ণিত। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘প্রতিটি বস্তুর জাকাত আছে। আর শরীরের জাকাত রোজা রাখা। ইবনে মাজা ১৭৪৫

রোজায় সুস্থতা লাভ হয় : হজরত আবু হুরায়রা (রা.)-এর সূত্রে বর্ণিত। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা রোজা রাখো, সুস্থ থাকো।’ (আল মুজামুল আউসাত ৪২০) আল্লাহতায়ালা আমাদের ইবাদতের বসন্তকাল রমজান মাস যথাযথভাবে ইবাদতের মাধ্যমে কাটানোর তৌফিক দান করুন। আমিন।