সাইফুল আলম :
একুশ শতকের সূচনালগ্নে দৈনিক যুগান্তরের যে যাত্রা শুরু হয়েছিল হাঁটি হাঁটি পা পা করে, আজ তা উনিশের তারুণ্যে পৌঁছেছে। বাংলা ভাষার সংবাদপত্রের ইতিহাসে যুগান্তরের সূচনা ছিল এক ভিন্নমাত্রার। নতুন শতকের শুরুতে নতুন চেতনায় ছিল সূচনালগ্নের সে যাত্রা। ২০০০ সালের ভাষার মাসে, ১ ফেব্রুয়ারি যুগান্তর প্রকাশের আগে বাংলাদেশের ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভাগীয় ও জেলা শহর এবং উল্লেখযোগ্য জনপদে যুগান্তরের সম্পাদক, সংবাদকর্মীরা অনেকগুলো মতবিনিময় সভায় সব শ্রেণীর মানুষের সঙ্গে মিলিত হয়েছেন।
সমাজের শিক্ষক, ছাত্র, চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী, রাজনীতিক, শিল্পী-সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিককর্মী, ক্রীড়াবিদ থেকে শুরু করে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা হয়েছে তাদের চাওয়া-পাওয়া নিয়ে। আমরা তাদের কাছে জানতে চেয়েছি- কেমন সংবাদপত্র তারা চান- কী কী বিষয় থাকলে তারা একটি নতুন পত্রিকাকে নিজেদের মুখপত্র বলে মনে করবেন? সেসব মতবিনিময় সভায় তারা তাদের চিন্তা-ভাবনা মেলে ধরেছেন অকপটে। আমরা তাদের সেই আশা-আকাঙ্খাকে বুকে ধারণ করে ফিরে এসেছি। তারপর তাদের স্বপ্নের পত্রিকাটি নির্মাণের কাজে মনোযোগী হয়েছি।
আমরা তাদের স্বপ্ন-আকাঙ্খাকে প্রতিফলিত করার চেষ্টা করেছিলাম নিউজপ্রিন্টের পাতায়, দৈনিক যুগান্তরের সুন্দর একটি লোগোর পরিচিতিতে। তার ফলাফল পাওয়া গিয়েছিল হাতে হাতে। তাদের কাছে বিপুলভাবে সমাদৃত হয়েছিল দৈনিক যুগান্তর। তারাও সানন্দে যুগান্তরকে বুকে তুলে নিয়েছিলেন। আর সেই পারস্পরিক হার্দিক সম্পর্কের পরিণতিতেই আজ যুগান্তরের উনিশ বছরের তারুণ্যে পা রাখা। যুগান্তর আজ এদেশের পাঠকের অন্তরজুড়ে থাকা এক স্পর্ধিত তারুণ্যের নাম। সত্যের সন্ধানে নির্ভীক যুগান্তর- অনেক বাধা-বিঘ্ন ও রক্তচক্ষুর ভ্রকুটি মোকাবেলা করে এগিয়ে চলেছে, এগিয়ে চলবে এটাই পাঠকের কাছে তার সুদৃঢ় অঙ্গীকার। আমরা এই অঙ্গীকার থেকে বিচ্যুত হইনি, বিচ্যুত হব না।
উনিশ বছরে পদার্পণের এই আনন্দঘন মুহূর্তে পেছনের দিকে তাকিয়ে আজ একটা কথাই মনে হচ্ছে- এদেশের মানুষ সাদাকে সাদা, আর কালোকে কালো বলে চিহ্নিত করতে জানেন। সত্যকে তারা সত্যিকারভাবেই ভালোবাসতে জানেন- সত্য প্রকাশের সাহসিকতাকে মনপ্রাণ উজাড় করে ভালোবাসার যে শক্তি সেই শক্তি জুগিয়ে তারা নিরন্তর আমাদের যাত্রাপথে সঙ্গী থেকেছেন।
১ ফেব্রুয়ারি, ২০০০-এ যুগান্তরের প্রথম যে সংখ্যাটি পাঠকের হাতে পৌঁছেছিল তার প্রথম কলামেই ছিল ‘সুপ্রভাত বাংলাদেশ’ নামে একটি বক্স আইটেম, আর সেদিনের প্রধান প্রতিবেদনটিও ছিল আমারই লেখা ‘সামনে অন্ধকার সিঁড়ি’। এ দুটি শিরোনামে আমরা সে সময়ের বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ের অন্তর্গত আশা-আকাঙ্খা এবং সে সময়ে বিদ্যমান সংঘাতপূর্ণ বাস্তবতাকেই তুলে ধরেছিলাম। সেদিনের সম্পাদকীয় কলামে সম্পাদক রবিঠাকুরের ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ কবিতার উদ্ধৃতি দিয়ে বন্ধুর পথে যুগান্তরের পা বাড়ানোর সাহসিকতার কথা ব্যক্ত করেছিলেন। আমরা এখনও সেই বন্ধুর পথের অভিযাত্রী। আমাদের যাত্রা আজও অব্যাহত রয়েছে, কারণ যেতে হবে আরও অনেক দূর।
সময় পাল্টেছে, পাল্টেছে চ্যালেঞ্জের ধরন, কিন্তু আমরা থেমে যাইনি, পিছিয়েও পড়িনি। গত আঠারো বছর এদেশের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সব ইস্যুতে আমরা সোচ্চার ছিলাম। এ সময়ের মধ্যে আরও অনেক সহযোগী প্রিন্ট মিডিয়া এসেছে। এসেছে ইলেকট্রুনিক গণমাধ্যম, অনলাইনের ব্যাপকতা, টিভি চ্যানেল, রেডিও। তারপরও আমরা প্রচার সংখ্যায় অগ্রবর্তী ছিলাম, অগ্রবর্তী আছি। প্রতি মুহূর্তের সংবাদ পাঠকের কাছে পৌঁছাতে যুগান্তর অনলাইনও এখন এগিয়ে। ইনশাআল্লাহ, পাঠকের আশা-আকাক্সক্ষার বাহন হয়ে অগ্রবর্তী থাকব।
‘অন্ধকার সিঁড়ি’র সামনে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের দুটি গন্তব্য ছিল। হয় নিচের দিকে নেমে যাওয়া কিংবা ওপরের দিকে উঠে আসা। এদেশের মানুষের অন্তরের বাণী ছিল এগিয়ে চলা, আলোর দিকে। সেই আকাঙ্খার শক্তিতে অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। জাতিসংঘের মিলেনিয়াম গোল-এমডিজি বাস্তবায়ন করেছে। এখন লক্ষ্য এসডিজি অর্জনের। সন্দেহ নেই আমাদের এই প্রিয় দেশ এসডিজিও অর্জন করবে সাফল্যের সঙ্গে। আমরা সে যাত্রায় নিরন্তর সহযোগী। দেশের সব শ্রেণীর মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে আমরা সর্বদাই সহযাত্রী। অতীতে যেমন ছিলাম, ভবিষ্যতে তার চেয়েও আরও দৃঢ়ভাবে থাকব।
আমরা সব সময় সংঘাতপূর্ণ রাজনীতির বিরোধিতা করেছি। স্বাধীন-সার্বভৌম দেশে রাজনৈতিক সংঘাত কোনো মানুষেরই পছন্দ নয়। আমরা চেয়েছি সুস্থ রাজনীতি। শান্তিপূর্ণ, জনমুখী, জনকল্যাণকামী রাজনীতির কোনো বিকল্প নেই। রাজনীতিতে আদর্শগত পার্থক্য থাকবে, থাকবে মতবিরোধ মতপার্থক্যও। কিন্তু তা কখনই হানাহানির কারণ হবে না- এটাই এদেশের মানুষের চাওয়া। আমরা মানুষের সেই আকাক্সক্ষার সঙ্গে থেকেছি, আছি আজও।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার অন্যতম অঙ্গীকার- অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণ। আমরা সাম্প্রদায়িকতা আর জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সব সময় থেকেছি আপসহীন ভূমিকায়। শুধু জন্মলগ্নেই নয়, যুগান্তর সব সময়ই সম্পৃক্ত থেকেছে জনগণের সঙ্গে। প্রতিটি বর্ষপূর্তির আগে ও পরে আমরা মতবিনিময় করতে মিলিত হয়ে থাকি সমাজের সব শ্রেণী-পেশার মানুষের সঙ্গে।
আমরা যেমন সারা দেশে ঘুরে ঘুরে সাধারণ জনগোষ্ঠীর রায় নিয়ে ‘জনতার ইশতেহার’ প্রকাশ করেছি, তেমনি বিভিন্ন ইস্যুতে আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে সমাজের প্রতিনিধিত্বশীল বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিক, অর্থনীতিবিদদের মতামত ও সুপারিশ জেনে তা তুলে ধরেছি দেশের নীতিনির্ধারক মহলের সামনে। তারা কখনও সেগুলো আমলে নিয়েছেন, আবার কখনও নেননি। কিন্তু আমরা আমাদের ভূমিকা পালনে অটল থেকেছি। ক্লান্ত হইনি। কারণ আমরা সেটাকে জনগণের জন্য আমাদের অবশ্য করণীয় তথা কর্তব্য বলে মনে করেছি।
বহু মত ও পথের বৈচিত্র্যকে ধারণ করাই সৎ সংবাদপত্রের লক্ষ্য। আমরা লালন করেছি সেই লক্ষ্যকে। আজ একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকের শেষ বর্ষে পা রেখে আমাদের উপলব্ধি এই- বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দ্রুত উৎকর্ষের এই যুগে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে একটি সংবাদপত্রকে জনগণের মুখপত্র হয়ে থাকার জন্য বহুমাত্রিক ও বহুরৈখিক বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ ও আকর্ষণীয় হতে হবে। কেবল সংবাদ পরিবেশনই নয়, জনগণের নাড়ির স্পন্দনের সঙ্গে সম্পর্ক থাকতে হবে সার্বক্ষণিক।
জনগণের স্বপ্নকে ভাষায় ব্যক্ত করতে হবে। তথ্যের ও সত্যের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। পাঠকের সামনে তুলে ধরতে হবে বৈচিত্র্যময় জ্ঞানের ভাণ্ডার।
এগিয়ে চলা বাংলাদেশে আমরা চাই- রাজনৈতিক সহনশীলতা, প্রকৃত গণতান্ত্রিক পরিবেশ আর মতপ্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা। সব মানুষের মৌলিক অধিকার পূরণের নিশ্চয়তা। আমরা স্বপ্ন দেখি সুখী, সমৃদ্ধ, শান্তিপূর্ণ এক অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের।
এ স্বপ্নপূরণে আমাদের সবাইকে কাজ করে যেতে হবে। বসে থাকার সময় নেই, ফিরে তাকানোর সুযোগ নেই। কাজ করে যেতে হবে সব সীমাবদ্ধতা জয় করে, মা, মাটি ও মানুষকে ভালোবেসে। আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ, যেতে হবে বহুদূর। আমেরিকান কবি রবার্ট ফ্রস্টের কবিতার ভাষায়-
But I have promises to keep,
And miles to go before I sleep,
And miles to go before I sleep.
‘চলা চলা শুধু চলা/মানা আছে কথা বলা/যেতে হবে বহুদূর…’
লেখক: সাইফুল আলম
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, দৈনিক যুগান্তর