মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ : ইসলামে মাদক সেবন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। মাদক মানুষের মস্তিষ্ককে বিকল করে দেয়। মাদক সেবনের ফলে কোনো মানুষ স্বাভাবিক কাজ করতে পারে না। হাদিসের বর্ণনা অনুযায়ী যেসব পানীয় নেশা সৃষ্টি করে তা হারাম। মাদকাসক্তি আধুনিক সভ্যতার ভয়ংকরতম ব্যাধিগুলোর অন্যতম। বিশ্বে অগণিত জ্ঞানী, বুদ্ধিজীবী ও অসংখ্য সফল মানুষের জীবন ও পরিবার ধ্বংস হয়েছে মাদকের ছোবলে। মাদক মানুষের বিবেক-বুদ্ধি ও দৈহিক স্বাস্থ্যের ভয়ংকর ক্ষতিসাধন করে। সঙ্গে সঙ্গে মানুষের দ্বীন ও পরকালের ক্ষতিও সাধন করে। একইভাবে এ কথা বলারও অপেক্ষা রাখে না যে, মাদক পরিবার-পরিজন ও জ্ঞাতি-বংশকে এমন বিপদ-বিপর্যয়ের মধ্যে ফেলে দেয়, যা থেকে বের হওয়া খুবই কঠিন।
মাদক মানুষের চারিত্রিক অস্তিত্বের প্রশ্নে হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। আর মাদক মানবজাতিকে যতটা কঠিন আঘাত দিয়েছে, ততটা কঠিন আঘাত আর অন্য কোনো কিছু দিতে পারেনি। যদি এ ব্যাপারে ব্যাপক পরিসংখ্যান চালানো হয় যে, বিশ্বের হাসপাতালগুলোতে যে সমস্ত রোগাক্রান্ত মানুষ থাকে, তাদের মধ্যে কতজন মাদকের কারণে মস্তিষ্ক বিকৃত ও দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়, কতজন মাদকের কারণে আত্মহত্যা করে, অন্যকে খুন করে, বিশ্বের কতজনের ওপর এই মাদকের কারণে স্নায়বিক ও পাকস্থলী রোগের অভিযোগ ওঠে, তাহলে এর সংখ্যা দাঁড়াবে অনেক।
আরবরা জাহেলি যুগে মদপানে প্রচণ্ড আসক্ত ছিল। মদের সঙ্গে ছিল তাদের গভীর বন্ধুত্ব ও অনুরক্ততা। তারা তাদের এ আসক্তি ও অনুরক্ততার কথা তাদের সাহিত্যের ভেতরেও প্রকাশ ঘটাত। এমনকি তারা মদের অনেক নামও দিয়েছিল। এর বিভিন্ন গুণাগুণ তাদের কবিতাগুলোতে উচ্চারিত হতো। বিভিন্ন আসরে আসরে বর্ণিত হতো এর রকমারি চমক।
যখন ইসলাম আবির্ভূত হলো, তখন ইসলাম মানুষদের একটি প্রজ্ঞাপূর্ণ পথে পরিচালিত করল। ইসলাম এসে তাদের ওপর মদকে হারাম করে দিল একটি ধারাবাহিকতা মেনে। তাদের প্রথম ধাপে মদ্যপ অবস্থায় নামাজ পড়া থেকে নিষেধ করা হলো। এরপর তাদের বলে দেওয়া হলো যে, মদের মধ্যে যেসব উপকারিতা রয়েছে, তার তুলনায় এর গুনাহ ও অপরাধের দিকটিই অধিক মারাত্মক। এরপর আল্লাহতায়ালা আয়াত নাজিল করে বলেন, ‘হে মুমিনরা, নিশ্চয় মদ, জুয়া, প্রতিমা-বেদি ও ভাগ্যনির্ধারক তীরসমূহ তো নাপাক শয়তানের কর্ম। সুতরাং তোমরা তা পরিহার করো, যাতে তোমরা সফলকাম হও। শয়তান তো মদ ও জুয়া দ্বারা তোমাদের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ ঘটাতে চায় এবং তোমাদের আল্লাহর স্মরণ ও নামাজে বাধা দিতে চায়। অতএব তোমরা কি তা থেকে বিরত হবে না?’ (সুরা মায়েদা ৯০-৯১)
মহান আল্লাহ এ দুই আয়াতে মদ ও জুয়াকে একেবারে চূড়ান্ত ও কঠোর ভাষায় হারাম করে দিয়েছেন। প্রথম আয়াতে ‘রিজসুন’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। যা শুধুমাত্র অশ্লীল, জঘন্য, বীভৎস ও পঙ্কিল জাতীয় কিছু বোঝাতেই ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এ ছাড়া মদ ও জুয়াকে শয়তানের কাজ বলে অভিহিত করা হয়েছে। আর শয়তানের কাজই হলো অশ্লীল ও বদ কাজ করা। এখানে মদপান ও জুয়াকে পরিহার করে চলার আহ্বান জানানো হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে এই পরিহার করাকে বানিয়ে দেওয়া হয়েছে সাফল্যের দিকে ধাবিত হওয়ার পথ। রাসুল (সা.) যখন সর্বপ্রথম মদ নিষিদ্ধ হওয়ার ঘোষণা দেন, তখন তিনি এদিকে মোটেও ভ্রƒক্ষেপ করেননি যে, কোন কোন জিনিস থেকে মদ তৈরি করা হয়। বরং তার মূল দৃষ্টি ছিল মদ মানুষের মধ্যে যে প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া ঘটায়, সেদিকে। আর সেটা হলো মাতলামি। কাজেই যে জিনিসের মধ্যেই এই মাদকতা ও নেশা শক্তি বিদ্যমান
থাকবে, সেটিই মাদক হিসেবে বিবেচিত হবে। চাই মানুষ সেটাকে যে নামেই অভিহিত করুক এবং যে জিনিস থেকেই তা প্রস্তুত করা হোক। সুতরাং ‘বিয়ার’ ও এ জাতীয় মাদকগুলোও হারাম। রাসুল (সা.)-এর কাছে মধু, ভুট্টা ও জব থেকে প্রস্তুতকৃত মদ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেছিলেন, ‘প্রত্যেক নেশাকর জিনিসই ‘খমর’ বা মাদক। আর প্রত্যেক খমরই হারাম।’ (সহিহ মুসলিম)
ইসলাম মাদক ব্যবসাকেও হারাম করেছে। সুতরাং কোনো মুসলমানের জন্য এ কাজ জায়েজ নয় যে, সে মাদক আমদানি-রপ্তানির কাজ করবে, মাদক ক্রয়-বিক্রয়ের দোকান দেবে কিংবা কোনো মাদকদ্রব্যের দোকানে কাজ করবে। রাসুল (সা.) মাদকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দশ শ্রেণির ব্যক্তির ওপর অভিশাপ দিয়েছেন। তারা হলো, ‘যে মাদক উৎপাদন করে, যে তা উৎপাদন করিয়ে নেয়, যে তা সেবন করে, যে তা বহন করে, যার কাছে তা বহন করে নিয়ে যাওয়া হয়, যে তা পরিবেশন করে, যে তা বিক্রি করে, যে তার মূল্য খায়, যে তা ক্রয় করে এবং যার জন্য তা ক্রয় করা হয়।’ (তিরমিজি)
সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে মাদক নির্মূল করার জন্য ইসলামি অনুশাসন প্রয়োজন। সুতরাং আমরা যদি ইসলামি অনুশাসন মেনে চলতে পারি তাহলে মাদক থেকে বাঁচতে পারব। আল্লাহতায়ালা মুসলিম উম্মাহকে মাদকের ভয়াবহ ছোবল থেকে রক্ষা করুন। কোরআন ও হাদিসের নির্দেশনা অনুযায়ী মদক ও মাদকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব জিনিস থেকে মুক্ত থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।