মহেষখালীতে তরুণীকে গণধর্ষণের ঘটনায় দুই ইউপি সদস্যসহ এক ধর্ষক গ্রেপ্তার

: নুরুল করিম রাসেল
প্রকাশ: ৫ years ago

কালের কন্ঠ :

একে একে ১৪ জন বখাটের হাতে কক্সবাজারের মহেশখালী দ্বীপে তরুণী ধর্ষণের ঘটনাটি ইতিমধ্যে তোলপাড় সৃষ্টি করেছে। এত বড় জঘন্য ঘটনা ধামাচাপা দিয়ে জড়িত ১৪ ধর্ষককে রক্ষার জন্য সর্বশেষ চেষ্টা করেছিলেন স্থানীয় দুই ইউপি সদস্য। তাদের একজন লিয়াকত আলী ও অপরজন খতিজা বেগম। তারা দু‌ইজনই স্থানীয় বিএনপি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। পুলিশ ওই ইউপি মেম্বারদ্বয়সহ একজন ধর্ষককেও গ্রেপ্তার করেছে। তাদের সবার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।

মামলাটি নিয়ে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এ বি এম মাসুদ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এত বড় একটি অপরাধজনক ঘটনা বেমালুম চাপা দিতে চেষ্টা করেছেন দুই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। তাদেরকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। আমি মনে করি কক্সবাজারের মতো জায়গায় এটা বড় ব্যাপার।’

এ প্রসঙ্গে তিনি আরো বলেন, কক্সবাজারের বিভিন্ন থানায় ইয়াবা কারবারসহ ভয়াল অপরাধের ঘটনায়ও এক শ্রেণীর জনপ্রতিনিধিসহ কতিপয় রাজনীতিকের তদবির প্রথা চালু রয়েছে। দুই জনপ্রতিনিধিকে মামলায় আসামি করায় তিনি আশাবাদী এবার কিছুটা হলেও তদবির হ্রাস পাবে।

এদিকে ধর্ষণের ঘটনার টানা পাঁচ দিন পর শুক্রবার বিকালে উদ্ধার হওয়া ধর্ষিতা তরুণীর মুখে ভয়াল বিবরণ শুনে পুলিশ এবং হাসপাতালে চিকিৎসকদের চোখেও পানি ঝরেছে। তরুণী বলছিলেন, ‘আমাকে পালাক্রমে ধর্ষণ করা হচ্ছিল। বেঁধে ফেলা হয়েছিল আমার হাত দুইটি। হায়েনাদের অত্যাচারের চোটে আমার গলার পানি বার বার শুকিয়ে যায়। এ সময় এক ফোটা পানি চেয়েছিলাম আমি। পানির বদলে আমাকে অকথ্য নির্যাতন করে পশুর দল। এমনকি পানি না দিয়ে বরং প্রস্রাব খাইয়ে দেওয়ার হুমকিও দিয়েছিল বদমাইশরা।’

মহেশখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রভাষ চন্দ্র ধর জানান, শুক্রবার রাতে মহেশখালী থানায় চাঞ্চল্যকর গণধর্ষণের ঘটনাটির ব্যাপারে একটি মামলা রুজু করা হয়েছে। ধর্ষিতা তরুণী বাদী হয়েছেন মামলাটিতে। মামলায় ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার জন্য আলামত নষ্ট করার অপচেষ্টাসহ অন্যান্য অভিযোগে ইউপি মেম্বারদ্বয়সহ ৬ জনের নাম উল্লেখ করে আরো অন্যান্যদের অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে।

মামলার পর পরই ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টায় জড়িত ইউপি মেম্বার লিয়াকত আলী ও খতিজা বেগমকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সেই সঙ্গে মনু মিয়া নামের একজন ধর্ষককেও গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তার হওয়া ধর্ষক মনু মিয়াকে রাতে থানায় এনে ধর্ষিতা তরুণীর সামনে নেওয়া হলে ওই তরণী ভয়ে চিৎকার দিয়ে উঠেন। গ্রেপ্তার হওয়া মনু মিয়াও পুলিশের কাছে ঘটনার কথা অকপটে স্বীকার করেছেন।

দুই ইউপি সদস্যসহ গ্রেপ্তার হওয়া তিনজনকে গতকাল শনিবার আদালতে চালান দিয়ে তাদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পাঁচ দিনের রিমান্ড চাওয়া হয়েছে। কিন্তু সাপ্তাহিক ছুটির কারণে আদালতের কার্যক্রম বন্ধ থাকায় আসামিদের কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

পুলিশ ও স্থানীয়দের অভিযোগ, গ্রেপ্তার হওয়া মহেশখালী দ্বীপ উপজেলার কালারমারছড়া ইউনিয়নের এক নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার লিয়াকত আলী ও নারী মেম্বার খতিজা বেগমের চাল-চলনই অস্বাভাবিক ধরনের। ঘটনার পর টানা পাঁচ দিন ধরে দুই মেম্বার ধর্ষকদের নিয়ে বৈঠকের পর বৈঠক করেছে ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য। তারা দুইজনই ধর্ষকদের নিকট থেকে বিপুল অংকের টাকাও আদায় করে নিয়েছেন ধর্ষিতাকে দেওয়ার কথা বলে। কালামারছড়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান তারেক বিন ওসমান জানিয়েছেন, ‘গ্রেপ্তার হওয়া আমার পরিষদের মেম্বার লিয়াকত আলী স্থানীয় বিএনপি’র তৃণমূল নেতা এবং খতিজা বেগমও বিএনপি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।’

কিন্তু শুক্রবার রাতে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকে মেম্বারদ্বয় সব কিছুই যেন অস্বীকার করে যাচ্ছেন। এমনকি ১৪ ধর্ষকের মধ্যে ১১ জনই ইউপি মেম্বারদ্বয়ের একই গ্রামের বাসিন্দা হলেও পুলিশকে তারা ধর্ষকদের নাম-ধামও দিতে রাজি হচ্ছেন না। তবে মেম্বারদ্বয় গণধর্ষণের ঘটনার কথা স্বীকার করে বলেছেন, ‘আমরা এলাকার বদনাম ঘুচাতেই ঘটনার কথা প্রকাশ করিনি।’

এদিকে মহেশখালী থানা পুলিশ গতকাল ধর্ষিতা তরুণীকে কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালে আংশিক ডাক্তারি পরীক্ষার পর আবার দ্বীপের থানায় নিয়ে গেছেন। আজ রবিবার তরুণীর বাদবাকি পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্পন্ন করা হবে। তরুণীর সঙ্গে রয়েছেন মহেশখালী দ্বীপের মাতারবাড়ি ইউনিয়নের শামীমা বেগম নামের আরেক নারী ইউপি মেম্বার।

নারী ইউপি সদস্য শামীমা বেগম ধর্ষিতা তরুণীর পালক মা। গ্রেপ্তার হওয়া ইউপি মেম্বারদ্বয় নানা ছলচাতুরির মাধ্যমে শামীমা বেগম মেম্বারের ঘরেই ধর্ষণের পর পাঁচ দিন ধরে তরুণীকে অবরুদ্ধ করে রেখেছিলেন। শামীমা বেগম জানান, মূলত কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার ডুলাহাজারা গ্রামের বাসিন্দা ধর্ষিতা তরুণী। তার বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করার কারণে মাও একই পথ বেছে নেন মহেশখালী দ্বীপের মাতারবাড়িতে।

এরপর থেকেই শামীমার কাছে তরুণীর আশ্রয় মিলে। পালক মা শামীমা জানান, ধর্ষিতা তরুণীর মতোই তার এক কন্যা ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। সেই কন্যার শোক তিনি ভুলে যান এই তরুণীর কাছে। পালক মা শামীমা জানান, তার কাছে সবচেয়ে বড় শংকার বিষয় হচ্ছে মামলার পর বাদী তরুণীর নিরাপত্তা এখন কে দেবে? কেননা ইতিমধ্যে ধর্ষকরা ধর্ষিতা তরুণীর আসল মাকে খুঁজে বের করে মামলা আপস করার জন্য চাপ দিতে শুরু করেছে।

প্রসঙ্গত, চট্টগ্রাম শহরে গৃহকর্মীর কাজ করা এই তরুণী মহেশখালীর মাতারবাড়িতে পালক মায়ের কাছে যাবার সময় গত ৭ জুলাই দ্বীপের চালিয়াতলী নামক স্থানে দুর্বৃত্তরা তাকে অপহরণ করে পাহাড়ী এলাকায় নিয়ে যায়। তাকে এক রাতেই ১৪ বখাটে গণধর্ষণ করে। পরের দিন সকালে স্থানীয় লোকজন তাকে উদ্ধারের পর পালক মা শামীমা বেগমের কাছে পৌঁছে দেন। সেই থেকে টানা পাঁচ দিন ধরে ওই বাড়িতে তাকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়।