‘মব জাস্টিস’ বলতে কী বোঝায়

: হুমায়ুন রশিদ
প্রকাশ: ৩ মাস আগে

সালাহ উদ্দিন শুভ্র : ‘মব জাস্টিস’ এখন প্রতি মুহূর্তে উচ্চারিত একটি শব্দ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই এ অনিয়ম চলে আসছে।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর থেকে বাংলাদেশে প্রতিনিয়ত উচ্চারিত একটি শব্দ হলো ‘মব জাস্টিস’। একদল মানুষ একত্র হয়ে কাউকে হেনস্তা এমনকি পিটিয়ে মেরে ফেলার বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। আর এসব ঘটনাকে বলা হচ্ছে ‘মব জাস্টিস’। সাধারণ অর্থে এক দল সংগঠিত ব্যক্তি আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে কাউকে শাস্তি দেওয়ার নাম ‘মব জাস্টিস’। বিভিন্ন তথ্য ও তত্ত্ব জানাচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই ‘মব জাস্টিস’ চলে আসছে। গবেষকরা বলছেন, ‘জনতার ন্যায়বিচার’ বা মব জাস্টিস হলো আইনের যথাযথ প্রক্রিয়া ছাড়া সাধারণত এক দল ব্যক্তি দ্বারা পরিচালিত বেআইনি শাস্তির একটি রূপ। তারা বলছেন, জনতার বিচার হলো একটি পরিস্থিতি যেখানে মানুষ ভিড় তৈরি করে আইন নিজের হাতে তুলে নেয়। তারাই কাউকে অভিযুক্ত করে, জুরি এবং বিচারক হিসেবে কাজ করে, এরপর সন্দেহভাজন বা কথিত অপরাধীকে ঘটনাস্থলে শাস্তি দেয়। এ পদ্ধতিতে প্রায় সময় কোনো ব্যক্তিকে পিটিয়ে মারা বা গুরুতর আহত করা হয়। তবে এসব ঘটনায় ‘মব লিঞ্চিং’ বলেও একটি শব্দ ব্যবহৃত হয়। ব্রিটানিকার সংজ্ঞা অনুযায়ী ‘লিঞ্চিং’ সহিংসতার একটি রূপ যেখানে জনতা বিনাবিচারে, প্রায়শই নির্যাতন এবং শারীরিক অঙ্গহানি ঘটিয়ে কোনো ‘অভিযুক্তকে’ মৃত্যুদণ্ড দেয়। তারা বলছে, ‘লিঞ্চ’ শব্দটি একটি স্ব-গঠিত আদালতকে বোঝায় যা আইনের যথাযথ প্রক্রিয়া ছাড়াই একজন ব্যক্তির ওপর শাস্তি আরোপ করে। আর এ শব্দটি চার্লস লিঞ্চের নাম থেকে উদ্ভূত হয়েছে। যিনি ভার্জিনিয়ার একজন চাষি। ‘ন্যায়বিচার’ প্রতিষ্ঠায় যিনি একটি অনিয়মিত আদালত গঠন করেন।

গবেষকরা বলছেন, মব জাস্টিস সামাজিক বৈষম্য, অর্থনৈতিক বঞ্চনা এবং ন্যায়বিচার প্রাপ্তির অভাবের কারণে ঘটে থাকে। তবে ইন্টারনেটের যুগে সরাসরি পেটানো ছাড়াও মব জাস্টিস চলমান আছে। সেখানে জনতা কোনো একটি ফৌজদারি অপরাধ, ব্যক্তিগত বিষয়ে মব জাস্টিসে লিপ্ত হয়।

ইতিহাস

ব্রিটানিকা এবং অন্যান্য গবেষণা প্রবন্ধ বলছে, ঐতিহাসিকভাবে মধ্যযুগের জার্মানিতে কিছু আদালত তৈরি করা হয় যা ‘লিঞ্চিংয়ে’ জড়িত ছিল। যেমন একটি আইন ছিল যেখানে চুরির জন্য দোষীদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হতো। ইংল্যান্ডের সীমান্ত জেলায়ও অতীতে এ ধরনের বিচার দেখা যেত। মধ্যযুগের স্পেন, রাশিয়া, পোল্যান্ডেও এমন আদালত ছিল। যার বেশিরভাগ পরিচালিত হতো ইহুদিদের বিরুদ্ধে। এসব আদালত গঠনে বৈধ কর্র্তৃপক্ষের অনুমোদন বা সায় ছিল। এটা অনেকটা সালিশের মতো ব্যবস্থা। প্রতিষ্ঠানিক ন্যায়বিচার অনুপস্থিত ছিল এমন জায়গায় এসব আদালত গঠন করা হতো। তবে পরিস্থিতি খারাপ হতে থাকে। বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রে নথিভুক্ত লিঞ্চিংয়ের পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়,১৮৮২ থেকে ১৯৫১ সালের মধ্যে ৪৭৩০ জনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। যাদের মধ্যে ১২৯৩ জন শ্বেতাঙ্গ এবং ৩৪৩৭ জন কালো ছিল। এমনকি ১৯৫০-৬০ এর দশকেও যুক্তরাষ্ট্রে জাতিগত অস্থিরতার সময় এই মব লিঞ্চিং দেখা দেয়।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়

হিউম্যান রাইটস এশিয়ার এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ন্যায়বিচারের সহজ প্রাপ্তির অভাবে অনেকে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার আশ্রয় নেয়। ‘মব জাস্টিস’ শুধু অনিয়ন্ত্রিত ক্ষোভের আকস্মিক বিস্ফোরণ বা একটি উন্মাদ জনতার অকথ্য বর্বরতা নয়। ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার প্রতি হতাশা, পুলিশের সক্রিয়তার অভাব এবং পুলিশ ও দায়িত্বশীল সম্প্রদায়ের মধ্যে আস্থার অভাবে জনতাই বিচারের দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নেয়। আধুনিক, উদারনৈতিক, গণতান্ত্রিক সমাজে এ ধরনের ন্যায়বিচারকে নৈতিকভাবে প্রশ্রয় দেওয়া বা সহ্য করা যায় না। তবে বিশ্বের মধ্যে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সরকারকে দেখা যায় বিষয়টি উপেক্ষা করতে। অনেক সময় মব জাস্টিসে জড়িতরা প্রমাণের অভাবে আদালত থেকে বেকসুর খালাস পায়। তারা উদাহরণ হিসেবে জানান, ২০১০ সালের আগস্টে পাকিস্তানের শিয়ালকোটে দুই কিশোর ভাইকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় বিচারক সাতজনকে মৃত্যুদণ্ড দেন এবং অপর্যাপ্ত প্রমাণের জন্য পাঁচজন সহ-অভিযুক্তকে খালাস দেওয়া হয়। একই ঘটনা দেখা যায় ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গার সময়। সেখানে বেস্ট বেকারি মামলা অনুযায়ী বিক্ষুব্ধ জনতা ১৪ জনের একটি মুসলিম পরিবারকে পুড়িয়ে হত্যা করে। তবে ২১ অভিযুক্তকে ২৭ জুন ২০০৩ তারিখে খালাস দেওয়া হয়। পরে ৯ জুলাই ২০১২ সালে মুম্বাই হাইকোর্ট চার অভিযুক্তের যাবজ্জীবন সাজা বহাল রাখে এবং প্রমাণের অভাবে পাঁচজনকে খালাস দেয়।

হিউম্যান রাইটস এশিয়া বলছে বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং ভারতে এ ধরনের ঘটনা ক্রমে বাড়ছে। অন্যান্য দেশেও এই অনিয়ন্ত্রিত জনতার সন্ত্রাস দেখা যায়।

উদাহরণ স্বরূপ জুলাই ২০১১ সালে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের নোয়াখালী এলাকায় ছয়জন কথিত ডাকাতকে জনতা পিটিয়ে হত্যা করে। আবার জনসমক্ষে পিটিয়ে মারার ভাইরাল ভিডিও আছে। যেখানে কিশোরকে মারতে মারতে একদল যুবককে হাসতে ও ঠাট্টা করতে দেখা যায়। ওই কিশোরকে নির্যাতনের এক পর্যায়ে তাকে পানি চাইতেও দেখা গেছে। একইভাবে ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় আসামের করিমগঞ্জ জেলায় ধর্ষণে অভিযুক্ত ব্যক্তির লিঙ্গ কেটে তাকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। আরেক ধর্ষককে কারাগার থেকে টেনেহিঁচড়ে ঝুলিয়ে হত্যা করেছে জনতা। ২০১৫ সালের ৫ মার্চ তারিখে অভিযুক্ত জনতা করিমগঞ্জের উচ্চনিরাপত্তার ডিমাপুর কেন্দ্রীয় কারাগারের গেট ভেঙে সৈয়দ ফরিদ খানকে রাস্তায় টেনে নিয়ে আসে। সেখানে তাকে নির্যাতন করা হয় এবং পরে কারাগারের নিরাপত্তারক্ষীদের উপস্থিতিতে ফাঁসিতে ঝুলানো হয়। ইন্দোনেশিয়ায় লিঞ্চিংয়ের অন্যতম প্রধান কারণ চুরি। দেশটির ন্যাশনাল ভায়োলেন্স মনিটরিং সিস্টেমের তথ্য অনুসারে নিহত, খারাপভাবে আহত বা স্থায়ীভাবে পঙ্গুত্বের শিকার হওয়া ২০ শতাংশ ব্যক্তি মব জাস্টিসের শিকার। ইন্দোনেশিয়ায় এক বছরে প্রায় ৪৩০০ মব জাস্টিসের ঘটনা ঘটে। এক বছরে তিন শতাধিক মানুষের মৃত্যুও হয়েছে জনতার হাতে। অনুরূপ প্রবণতা শ্রীলঙ্কায় লক্ষ করা যায়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামাজিক অসহিষ্ণুতা এবং দীর্ঘ ও অকার্যকর আইনি প্রক্রিয়ার ক্রমবর্ধমান হতাশা মানুষকে ক্ষুদ্র অপরাধীদের প্রতি প্রতিশোধ নিতে বাধ্য করেছে। অন্যদিকে দুর্নীতিগ্রস্ত নেতারা প্রভাবশালী এবং ধনী হওয়ার কারণে বিচারব্যবস্থাকে অকার্যকর করে তুলছে। যার কারণে উত্তেজিত জনতার মনে ন্যায়বিচারের এক ধরনের আকাক্সক্ষা তৈরি হয়। যার বহিঃপ্রকাশ অবশ্য ঘটে অন্যায়ভাবে।

বাংলাদেশে

বিবিসি বাংলার প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, গত ৫ আগস্টের পর বগুড়া, মাদারীপুর, টাঙ্গাইল, চট্টগ্রাম, খুলনা, মিরসরাই, যাত্রাবাড়ী, টঙ্গী, রাজশাহী এবং বরিশালে গণপিটুনির ঘটনায় ২১ জন নিহত এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়েছে। প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে আরও বেশি হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য মতে, দেশে গত সাড়ে ছয় বছরে গণপিটুনিতে কমপক্ষে ২৮৬ জনকে হত্যা করা হয়েছে। এর কোনোটিতে ছেলেধরা বা ডাকাত সন্দেহে, আবার কোনো কোনো ঘটনায় চোর সন্দেহেও পিটিয়ে মেরে ফেলার ঘটনা ঘটেছে। অধিকাংশ ঘটনায় হত্যা মামলা হলেও শাস্তি হওয়ার সংখ্যা খুব কম। মানবাধিকারকর্মী নূর খানের মতে, গত ১৫/১৬ বছর মানুষ স্বৈরাচার ও তাদের দোসরদের দ্বারা নানাভাবে নিপীড়িত হয়েছিল। এতে সব ধরনের মানুষের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ জমা ছিল। ৫ আগস্টের পরবর্তী সময়ে মব জাস্টিসের মতো নানা সহিংসতার মাধ্যমে সেই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটছে যা কোনোভাবে কাম্য নয়। এ ক্ষেত্রে যত দ্রুত সম্ভব রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের এমন অপকর্ম থেকে দলীয় কর্মীদের বিরত রাখতে কঠোর বার্তা দেওয়া জরুরি বলে তিনি মনে করেন। তিনি বলেন, এখন জরুরি হলো জনগণের মধ্যে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে যেন স্বৈরশাসনের পুনরাবৃত্তি না হয়। অপরাধীকে শাস্তি দেওয়ার এখতিয়ার শুধুমাত্র বিচারব্যবস্থার, আর কারও নয়। পাশাপাশি সর্বস্তরের নাগরিকদেরও এসব অপরাধ নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখার তাগিদ দিয়েছেন তিনি।

অনলাইনে

অনলাইনেও মব জাস্টিসের নানা ঘটনা দেখা যায় নিয়মিত। যার মাধ্যমে একজন ব্যক্তিকে হত্যা করা না গেলেও তার জীবন বরবাদ হয়ে যায়। শুধু বাংলায় নয়, অন্যান্য ভাষভাষীদের ক্ষেত্রেও এ প্রবণতা দেখা দেয়। একজন ব্যক্তির গোপন তথ্য সবার সামনে নিয়ে এসে তাকে নাজেহাল করা হয়। আবার কখনো খণ্ডিত অংশ তুলে ধরা হয়। অপরাধীরা বিকৃত ছবি বা তথ্য দিয়েও ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে বিষোদগার করেন। এভাবে অনলাইনেও মব জাস্টিস চালু আছে। ইন্টারনেট ব্যবহার করে কখন থেকে এই ‘ন্যায়বিচারের’ চল শুরু হয় তা বলা কঠিন। প্রথম ঘটনাটি সম্ভবত ১৯৯০ সালে। একটি সফটওয়্যার জায়ান্ট লোটাস এবং ক্রেডিট রিপোর্টিং সংস্থা ইকুইফ্যাক্স মার্কেটপ্লেস নামে একটি ডাটাবেজ তৈরির পরিকল্পনা করে। এটি ১২০ মিলিয়ন আমেরিকানের নাম, ঠিকানা এবং তাদের ব্যয় করার অভ্যাস তালিকাভুক্ত করে। এটি ছিল মানুষের গোপনীয়তা লঙ্ঘনের বিশাল ঘটনা। তবে বেশিরভাগ মানুষ এ সম্পর্কে জানে না। এভাবে তথ্য ফাঁসের মাধ্যমে অনলাইনে মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য জনতার হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়। বিষয়টি সবাই জানতে ও বুঝতেও পারেনি। তবে এ ঘটনা পরে একটি সংস্কৃতিতে রূপান্তরিত হয়। মানুষের তথ্য অনলাইনে যার-তার হাতে যে ছেড়ে দেওয়া যায়, সেই বুদ্ধি গজিয়ে যায়। পরে সামাজিক মাধ্যমের বিস্তার ঘটে। ধীরে ধীরে এ প্রবণতা একটি ট্রেন্ড হয়ে ওঠে। এখন যা মহামারী আকার ধারণ করেছে। এ অবস্থায় ব্যক্তিকে খুব সাবধানে সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করতে হয়। তবে দুর্বলতার সুযোগে কোনো ব্যক্তির তথ্য অন্যদের হাতে উঠে যাওয়ার এ মব জাস্টিস কবে বন্ধ হবে তা কেউ জানে না।