টেকনাফ টুডে ডেস্ক :রাজধানীসহ সারা দেশে শীত জেঁকে বসেছে। বৃহস্পতিবার সকালে চুয়াডাঙ্গায় দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৭ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে।
চলতি মৌসুমে এটাই সর্বনিম্ন তাপমাত্রা। এ ছাড়া রাজশাহী, পাবনার ঈশ্বরদী, নওগাঁর বদলগাছী, কুড়িগ্রামের রাজারহাট ও যশোরে থার্মোমিটারের পারদ ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে এসেছে।
আবহাওয়া অফিস জানায়, রাজশাহী, পাবনা, নওগাঁ, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, যশোর ও চুয়াডাঙ্গা অঞ্চলের ওপর দিয়ে মৌসুমের প্রথম শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। বুধবার থেকে এ শৈত্যপ্রবাহ শুরু হয়েছে। এদিন দেশের মধ্যে কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১০ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
এবার শীত যেন পঞ্জিকা ধরেই নেমে আসছে। তবে পৌষের শুরুতেই যে শীত জেঁকে বসবে, সেই পূর্বাভাস দিয়েছিল আবহাওয়া অফিস। শীতের তীব্রতা বাড়ায় জনজীবনে দুর্ভোগ দেখা দিয়েছে।
বিশেষ করে খেটে খাওয়া গরিব মানুষের দুর্ভোগ-দুর্দশা বেড়ে গেছে। ঠাণ্ডাজনিত ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, জ্বর-সর্দি-কাশি ইত্যাদি রোগবালাইয়ে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। বিশেষ করে শিশু ও বয়স্কদের দুর্ভোগ বেশি বেড়েছে। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে শীতজনিত রোগে আক্রান্তের ভর্তির হার বেড়েছে।
শীতের সঙ্গে আছে হিমালয় থেকে আসা ঠাণ্ডা বায়ুর প্রবাহ। আছে ঘন কুয়াশাও। কুয়াশার প্রকোপ বাড়ায় বিভিন্ন স্থানে সূর্য দেখা যায়নি। ঢাকা, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইলসহ আশপাশ এলাকায় বৃহস্পতিবার সারা দিন সূর্যের মুখ দেখা যায়নি।
বিকাল থেকে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বইতে শুরু হয়। সন্ধ্যার পর থেকে বৃষ্টির মতো কুয়াশা পড়ে। আর ভোর থেকে চারপাশ ঘন কুয়াশায় ঢেকে যায়। ঘন কুয়াশায় আলোর স্বল্পতা সৃষ্টি হওয়ায় সারা দেশে নৌপথ ও সড়কপথে যানবাহন চলাচল বিঘ্নিত হচ্ছে। দিনের বেলায় হেডলাইট জ্বালিয়ে যানবাহন চালানো হচ্ছে। রাস্তাঘাট ও হাটবাজারে মানুষের চলাচল কমে গেছে।
হঠাৎ শীতের কারণে ঢাকাসহ সারা দেশে গরম কাপড়ের বিক্রি বেড়েছে। এদিকে পর্যাপ্ত গরম কাপড় না পেয়ে বিপাকে পড়েছেন অনেক দরিদ্র মানুষ। আবহাওয়াবিদ ওমর ফারুক বলেন, বুধবারের তুলনায় বৃহস্পতিবার শীতের তীব্রতা বেড়েছে। একদিনে তাপমাত্রার রেকর্ড নিম্নমুখী প্রায় তিন ডিগ্রি। বর্তমানে চুয়াডাঙ্গা, যশোর, রাজশাহী, পাবনা, নওগাঁ, কুড়িগ্রাম ও নীলফামারীতে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বিরাজ করছে। শীতের এ তীব্রতা শনিবার পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের আবাসিক চিকিৎসক ডা. রাজেশ মজুমদার যুগান্তরকে বলেন, শীতের তীব্রতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রোটা ভাইরাসজনিত ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়ার প্রকোপ বাড়ে। সাধারণত শিশুরা এতে বেশি আক্রান্ত হয়।
তাই শিশুদের প্রতি বিশেষ যত্ন নিতে হবে। বিশুদ্ধ পানি পান করতে হবে। চারপাশ পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। ছয় মাসের কম বয়সী শিশুদের মায়ের বুকের দুধ ছাড়া অন্যকিছু খাওয়ানো থেকে বিরত থাকতে হবে। তাদের প্রতিদিন গোসল করানোরও দরকার নেই।
শিশুদের মাথায় তেল দেয়া যাবে না। শরীরে অলিভ অয়েল মাখা ভালো। সব সময় গরম কাপড় পরাতে হবে। ঠাণ্ডা লাগলে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
বয়স্কদের ক্ষেত্রেও একই ধরনের সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। আবহাওয়াবিদরা জানান, তাপমাত্রা ৮-১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে গেলে শৈত্যপ্রবাহের সৃষ্টি হয়। একে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বলা হয়।
তাপমাত্রা ৬-৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে গেলে শৈত্যপ্রবাহকে মাঝারি মাত্রার এবং তাপমাত্রা ৪-৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে গেলে তীব্র শৈত্যপ্রবাহের সৃষ্টি হয়। বৃহস্পতিবার ঢাকায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে যুগান্তর প্রতিনিধিরা জানান, শৈত্যপ্রবাহের কারণে জনজীবনে দুর্ভোগ নেমে এসেছে। উষ্ণতার খোঁজে মানুষ গরম পোশাকের সন্ধান করছেন। খড়কুটো জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করছে অনেকে।
রংপুরের পীরগাছার পারুল ইউনিয়নের গুঞ্জরখাঁ গ্রামের সাদ্দাম হোসেনের সন্তানসম্ভবা স্ত্রী ফরিদা বেগম (২৪) ও কান্দি ইউনিয়নের কাবিলাপাড়ার মোংলা কুমারের স্ত্রী পুতুল রানী আগুন পোহাতে গিয়ে অগ্নিদগ্ধ হয়েছেন। তাদের রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে ভর্তি করা হয়েছে। শৈত্যপ্রবাহ ও ঘন কুয়াশার কারণে লোকজন, বিশেষ করে, উত্তরাঞ্চলে গরিব মানুষ ঘর থেকে বের হচ্ছে কম। প্রয়োজন ছাড়া অনেকে ঘর থেকে বের হচ্ছে না। কাজে যেতে না পারায় অনেকে পরিবার নিয়ে বিপাকে পড়েছে।
রংপুর ব্যুরো জানায়, হঠাৎ জেঁকেবসা শীতে ভোগান্তির শিকার হচ্ছে হিমালয়ের নিকটবর্তী জনপদ পঞ্চগড়, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, রংপুর, লালমনিরহাট, নীলফামারীসহ উত্তরাঞ্চলের ছিন্নমূল ও দরিদ্র মানুষ।
তিস্তা, ধরলা, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, করতোয়া নদীর তীরবর্তী চরাঞ্চলের গরিব মানুষ গরম কাপড়ের তীব্র অভাবে রয়েছে। রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সূত্র জানায়, শীতের কারণে শিশু ও বৃদ্ধরা সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। হাসপাতালের বহির্বিভাগে রোগীর সংখ্যা অনেক বেড়েছে।
রাজশাহী ব্যুরো জানায়, চারদিনে প্রতিদিন গড়ে দুই থেকে তিন ডিগ্রি সেলসিয়াস করে তাপমাত্রা কমছে। হঠাৎ জেঁকেবসা শীতে খেটে খাওয়া দিনমজুর বেশি ভোগান্তিতে পড়েছে।
কাজের সন্ধানে বের হতে না পেরে তাদের জীবিকা হুমকির মুখে পড়েছে। বৃহস্পতিবার ভোরে রাজশাহীতে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ৯ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বর্তমানে এ অঞ্চলের ওপর দিয়ে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে।
গাইবান্ধা প্রতিনিধি জানান, শীতের কারণে জেলায় লেপ-তোশক বানানোর হিড়িক পড়েছে।
পাবনা প্রতিনিধি জানান, পদ্মা-যমুনা নদী বেষ্টিত পাবনায় তিন দিন ধরে শৈত্যপ্রবাহ বিরাজ করছে। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা এবং হিমেল হাওয়ায় জনজীবন বিপন্ন হয়ে পড়েছে। বৃহস্পতিবার ঈশ্বরদী আবহাওয়া অফিসে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়।
তীব্র শীতে এ অঞ্চলে দুস্থ মানুষের মধ্যে শীতবস্ত্রের সংকট দেখা দিয়েছে। জেলা প্রশাসক কবীর মাহমুদ জানান, বিভিন্ন উপজেলায় ৪৮ হাজার কম্বল পাঠানো হয়েছে। তবে তা অপ্রতুল বলে জানিয়েছেন ইউপি চেয়ারম্যানরা। পাবনার পৌর হকার্স মার্কেটগুলোতে পুরনো কাপড় বিক্রির ধুম পড়েছে। ফুটপাতের কাপড়ের দোকানগুলোতে মানুষজন শীতবস্ত্র কিনতে ভিড় করছেন।
লালমনিরহাট প্রতিনিধি জানান, প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় কাহিল হয়ে পড়েছেন মানুষজন। বিশেষ করে নিম্নআয়ের লোকজন কষ্টে পড়েছেন। হাড় কাঁপানো শীতে সবচেয়ে বেশি কষ্টে পড়েছেন শিশু, বৃদ্ধ ও প্রতিবন্ধীরা।
লালমনিরহাটের সিভিল সার্জন ডা. কাসেম আলী জানান, এক সপ্তাহে ডায়রিয়াসহ শীতজনিত রোগে ১২২ জন রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। ২৪ ঘণ্টায় জেলার পাঁচটি হাসপাতালে ৩০ শিশু ভর্তি হয়েছে।
এদিকে সরকারি ও বেসরকারিভাবে শীতবস্ত্র হিসেবে কম্বল বিতরণ করা হলেও তা অপ্রতুল বলে জানা গেছে। জেলা প্রশাসক আবু জাফর বলেন, শীতার্ত মানুষজনের মাঝে কম্বল বিতরণ করা হচ্ছে। নতুন করে শীতবস্ত্র চেয়ে মন্ত্রণালয়ে চাহিদাপত্র পাঠানো হয়েছে।
বগুড়া ব্যুরো জানায়, হঠাৎ শীত বৃদ্ধি পাওয়ায় স্টেশন, টার্মিনাল, রোড ডিভাইডারসহ বিভিন্ন খোলা স্থানে আশ্রয় নেয়া জনগণের দুর্ভোগ বেড়েছে। অনেকে আগুন জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করছেন। বগুড়া রেলস্টেশনের পাশে আশ্রয় নেয়া গাবতলীর নাড়–য়ামালার ভিক্ষুক আলফাজ হোসেন (৫৫), ভেলুরপাড়ার ভবঘুরে মিলন হোসেন (৩৬), পথশিশু শহিদুল (১৪) জানান, হঠাৎ শীত বৃদ্ধি পাওয়ায় তাদের খুব কষ্ট হচ্ছে।
রিকশাচালক সারিয়াকান্দির মোসাদ্দেক হোসেন জানান, দুপুর থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত তিনি শহরে রিকশা চালান। কিন্তু শীত বৃদ্ধি পাওয়ায় রাতে তার রিকশা চালাতে কষ্ট হচ্ছে। শীতের তীব্রতা বৃদ্ধি পাওয়ায় শহরের হকার্স মার্কেট, সাতমাথাসহ বিভিন্ন স্থানে গরম কাপড় বিক্রি বেড়েছে। দোকানগুলোতে ক্রেতাদের উপচে পড়া ভিড় লক্ষ করা গেছে।