পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় ইসলামের নির্দেশনা

: হুমায়ুন রশিদ
প্রকাশ: ১ বছর আগে

ড. আবু সালেহ মুহাম্মদ তোহা : মহান আল্লাহ এই সুন্দর পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। আকাশ, বাতাস, ভূমি, সাগর-মহাসাগর, পাহাড়-পর্বত ঘেরা গাছ-গাছালি আর পাখ-পাখালিতে সমৃদ্ধ অপূর্ব সুন্দর পৃথিবীকে মানুষের বাসযোগ্য করে গড়ে তোলার পর তাতে মানব জাতিকে প্রেরণ করেছেন। সব মানুষের মৌলিক প্রয়োজন মেটানোর জন্য প্রয়োজনীয় সব কিছু পরিমাণমতোই তিনি সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ বলেন, ‘আমি প্রত্যেক বস্তুকে পরিমিতরূপে সৃষ্টি করেছি।
’ (সুরা কামার, আয়াত : ৪৯)

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিশ্বব্যাপী প্রাকৃতিক দুর্যোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ক্ষেত্রে মানুষের নানাবিধ কর্মকাণ্ডের প্রভাব রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম প্রধান কারণ— পরিবেশ দূষণ। এর জন্য মানুষের কৃতকর্ম অনেকাংশে দায়ী।
মহান আল্লাহ হয়তো কখনো বান্দাকে পরীক্ষা করার জন্য বিপদাপদ দেন; কিন্তু স্বাভাবিকভাবে এমনিতেই দুর্যোগ বা বিপদাপদ দেন না; বরং তারা নিজেদের কৃৃতকর্মের কারণে এসব বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। আল্লাহ বলেন, ‘স্থলে ও জলে মানুষের কৃতকর্মের ফলে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে। আল্লাহ তাদেরকে তাদের কর্মের শাস্তি আস্বাদন করাতে চান, যাতে তারা ফিরে আসে।’ (সুরা রুম, আয়াত : ৪১)
পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় ইসলামের সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে।

১. ভূমির পরিকল্পিত ব্যবহার : ভূমির যথাযথ ও পরিকল্পিত ব্যবহার নিশ্চিত হলে পরিবেশের ভারসাম্য সহজেই ফিরে আসবে। এ জন্য কৃষি জমিতে চাষাবাদ ও বনায়ন করতে হবে। নিজে আবাদ করতে না পারলে অন্যকে বর্গা অথবা এমনিতেই আবাদ করতে দিতে হবে। অকৃষি জমিতে ঘর-বাড়ি, খামার, বাণিজ্যিক অথবা অবাণিজ্যিক স্থাপনা অথবা অন্য কোনোভাবে ব্যবহার করতে হবে। বাড়ির আশপাশের খালি জায়গা, বাড়ির ছাদ, বাড়ি নির্মাণের জন্য বরাদ্দ পাওয়া ফাঁকা প্লট এবং নিজ নিজ মালিকানাধীন জায়গা-জমির যথার্থ ব্যবহার হলে জাতির অবস্থা কখনোই শোচনীয় হবে না।
জমির পরিকল্পিত ব্যবহার নিশ্চিত করতে হাদিসে বারবার বলা হয়েছে। জাবির ইবনু আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যার কাছে জমি আছে সে যেন তা (নিজে) চাষাবাদ করে। যদি সে (নিজে) চাষাবাদ না করে তবে যেন তার কোনো ভাইকে চাষাবাদ করতে দেয়।’ (মুসলিম, হাদিস : ৩৭৭৩)

২. বৃক্ষরোপণ ও বনায়ন : বৃক্ষ-তরুলতা প্রকৃতির প্রাণ এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় অতি প্রয়োজনীয় উপাদান। কাজেই বৃক্ষরোপণ ও পরিচর্যা করতে হবে। অপ্রয়োজনে বৃক্ষ-তরুলতাকে নষ্ট করা যাবে না। আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেন, ‘যদি নিশ্চিতভাবে জানো যে কিয়ামত এসে গেছে, তখন হাতে যদি একটি গাছের চারা থাকে, যা রোপণ করা যায়, তবে সেই চারাটি রোপণ করবে।’ (বুখারি, আদাবুল মুফরাদ : ৪৭৯; মুসনাদ আহমদ, হাদিস : ১৮৩)

অন্য হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি বিনা প্রয়োজনে গাছ কাটবে (যে গাছ মানুষের উপকার করত) আল্লাহ তার মাথা আগুনের মধ্যে নিক্ষেপ করবেন।’ (বায়হাকি, হাদিস : ১৪০)। রাসুলুল্লাহ (সা.) বৃক্ষরোপণ করতে উৎসাহ দিয়েছেন। এটিকে সাদকা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। জাবির (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে মুসলমান কোনো বৃক্ষ রোপণ করে, তারপর তা থেকে কোনো মানুষ, পশু বা পাখি ভক্ষণ করে, এর বিনিময়ে কিয়ামতে তার জন্য একটি সদকার সাওয়াব রয়েছে।’ (মুসলিম শরিফ, হাদিস: ৪০৫৩)

৩. প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার : জীবন ধারণের মূল উপাদানগুলো মহান আল্লাহ সহজ করে দিয়েছেন। যেমন— পানি, বাতাস ইত্যাদি। এসবের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। সহজলভ্য বলে অপচয় ও অপব্যবহার করা যাবে না। বর্ষায় চারদিকে পানি বেড়ে গেলেও পানির অপচয় ও অপব্যবহার রোধ করতে হবে। অপচয় সব সময়ই নিষেধ। আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, একবার রাসুলুল্লাহ (সা.) সাদ (রা.)-এর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, যখন তিনি অজু করছিলেন। রাসুল (সা.) বললেন, ‘কেন এই অপচয়?’ সাদ (রা.) বলেন, অজুতেও কি অপচয় হয়?’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘হ্যাঁ, এমনকি প্রবাহিত নদীতে অজু করলেও।’ (ইবনু মাজাহ, হাদিস : ৪২৫)

৪. পানি দূষণ প্রতিরোধ : পানি প্রাকৃতিক পরিবেশের প্রধান উপাদান। পানি ছাড়া প্রাণীর অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। সে জন্য পানিকে নিরাপদ ও দূষণমুক্ত রাখতে হবে। নিজেদের কোনো কর্মে যেন পানি দূষিত না হয় সে ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) পানিকে পবিত্র, নিরাপদ ও দূষণমুক্ত রাখতে সবাইকে সচেতন করেছেন। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেন, ‘তোমাদের কেউ যেন আবদ্ধ পানিতে প্রসাব করে অতঃপর সেখানে গোসল না করে।’ (বুখারি, হাদিস : ২৩৬; মুসলিম, হাদিস : ৬৮২)

৫. বায়ু দূষণ প্রতিরোধ : মুক্ত ও পরিচ্ছন্ন বাতাস প্রকৃতি ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে। পক্ষান্তরে দূষিত বাতাস স্বল্প সময়ে প্রকৃতির নির্মলতা নষ্ট করে দেয়। বায়ু দূষণের ফলে স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয়, পরিবেশ ও সম্পদ নষ্ট হয়। এর ফলে বায়ুমণ্ডলে ওজন স্তর পাতলা হয়ে যায়। এসব বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ হয়। বায়ুকে দূষণমুক্ত রাখতে ইসলামের যথেষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। মু’আজ ইবন জাবাল (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমরা অভিশাপ ডেকে আনে এরূপ তিনটি কাজ থেকে বিরত থাকো। চলাচলের রাস্তায়, রাস্তার মোড়ে অথবা ছায়াদার স্থানে মলমূত্র ত্যাগ করা থেকে।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ২৬)

৬. জীবজন্তুর প্রতি নিষ্ঠুরতা পরিহার : জলবায়ু পরিবর্তন বা পরিবেশের ভারসাম্যহীনতার জন্য জীববৈচিত্র্য ধ্বংস অনেকাংশে দায়ী। এ জন্য বন্য ও গৃহপালিত পশু-পাখির প্রতিও ভালোবাসা প্রদর্শন ও দয়াশীল আচরণ করতে হবে। কোনো প্রাণীর প্রতি নিষ্ঠুর অচরণ করা যাবে না। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, সাহাবিরা জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসুল, জীবজন্তুর প্রতি দয়া প্রদর্শনের জন্যও কি আমাদের পুরস্কার আছে? রাসুল (সা.) বললেন, ‘হ্যাঁ। প্রত্যেক দয়াদ্র হৃদয়ের অধিকারীদের জন্য পুরস্কার আছে।’ (বুখারি, হাদিস : ৫৬৬৩)

এ ছাড়া পশু কোরবানির সময় ধারালো অস্ত্র দিয়ে জবেহ করার এবং এ ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বনের শিক্ষা দেওয়া হয়েছে, যাতে পশুর কোনো কষ্ট না হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘যখন তোমরা জবাই করবে, সর্বোত্তম পন্থায় করবে। জবাইয়ের বস্তু ভালোভাবে ধার দিয়ে নেবে আর পশুটিকে স্বাভাবিকভাবে প্রাণ বের হওয়ার সুযোগ দেবে।’ (মুসলিম, হাদিস : ১৯৫৫)

ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) ওই ব্যক্তিকে অভিশাপ দিয়েছেন, যে প্রাণীদের অঙ্গচ্ছেদ করে।’ (বুখারি, হাদিস : ৫১৯৫)

এভাবে বিভিন্ন নির্দেশনার মাধ্যমে জীবজন্তুর প্রতি নিষ্ঠুরতা পরিহার করতে বলা হয়েছে।

পরিশেষে বলা যায়, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় ইসলামের নির্দেশনাগুলোর সফল বাস্তবায়ন বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তন রোধে অনন্য ভূমিকা রাখতে পারে। ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেয়ে পৃথিবী আবারও বাসযোগ্য হয়ে উঠবে।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক

আরবি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।