আবু নাঈম : বাঙালির সুপ্রাচীন কালের ঐতিহ্য পান-সুপারি। অভ্যাসগত কারণে তো বটেই, ভোজনের অনুষ্ঠান শেষে কিংবা বাড়িতে অতিথি আপ্যায়নে যেন জুড়ি নেই এর। দেশের প্রায় সর্বত্রই সুপারি উৎপাদন হলেও কয়েকটি জেলায় এটির আবাদ বেশি হয়ে থাকে। তার মধ্যে পঞ্চগড় অন্যতম। গত কয়েক বছর ধরে ব্যাপকহারে আবাদ হওয়া পঞ্চগড়ের সুপারি স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন জেলায় রপ্তানি হচ্ছে।
কৃষি বিভাগ বলছেন, পঞ্চগড় জেলার অর্থনীতিতে বড় একটা অংশ দখল করে আছে সুপারি। বছরে এ জেলায় ৩০ কোটি টাকার সুপারি বেচাকেনা হচ্ছে। এতে করে দিনদিন সুপারি চাষে আগ্রহী হয়ে উঠছেন চাষিরা।
জেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, কেউ পতিত জমিতে, কেউ বাড়ির আঙিনায়, আবার কেউ জমির সীমানা নির্ধারণ ঠিক রাখতে সারি সারি করে লাগিয়েছেন সুপারি গাছ। কয়েক বছর ধরে এ অঞ্চলে চা শিল্প বিপ্লবে মিশ্র চাষ হিসেবে চা বাগানে সুপারি গাছ লাগিয়েছেন চাষিরা। চৈত্র-বৈশাখ মাসে গাছ থেকে সংগ্রহ করে স্থানীয় বাজারে সুপারি বিক্রি করছেন চাষিরা।
জেলা শহরের জালাসী, সদর উপজেলার হাড়িভাসা এবং টুনিরহাটসহ কয়েকটি বাজারে প্রচুর পরিমাণে সুপারি বেচাকেনা হতে দেখা যাচ্ছে এখন। সপ্তাহের নির্ধারিত দিনগুলোতে এসব বাজারে জমে ওঠে সুপারির বাণিজ্য। আকারভেদে এসব বাজারে প্রতি পণ (৮০ পিস) সুপারি বিক্রি হচ্ছে ৩০০-৪০০ টাকা দরে। এছাড়া ব্যবসায়ীদের অনেকেই চাষিদের বাড়ি বাড়ি গিয়েও কিনছেন সুপারি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বৈশাখ এবং জৈষ্ঠ্য- এই দুইমাস পঞ্চগড়ে সুপারির ভরা মৌসুম। এই সময়টাতে দক্ষিণাঞ্চলসহ অন্যান্য অঞ্চলে সুপারির উৎপাদন না থাকায় দেশের বড় বড় সুপারি ব্যবসায়ীরা এখন অবস্থান করছেন পঞ্চগড়ে। তারা বিভিন্ন হাট থেকে সুপারি কিনে ট্রাকে করে নিয়ে যাচ্ছেন দেশের বিভিন্ন স্থানে। এছাড়া স্থানীয় ব্যবসায়ীরাও পাকা সুপারি কিনে মজুত করছেন। তারা সুপারি মাটিতে পুঁতে রাখবেন। দুই মাস পর এই সুপারি মাটি থেকে তুলে মজা সুপারি হিসেবে অধিক দামে বিক্রি করবেন।
সুপারি ব্যবসায়ীরা জানান, পঞ্চগড়ের সুপারি আকার, স্বাদ ও রঙে তুলনামূলকভাবে ভালো। এ কারণে দেশজুড়ে এখানকার সুপারির চাহিদা ব্যাপক। স্থানীয় বাজারের চাহিদা মিটিয়ে রাজধানীসহ বিভিন্ন জেলায় রপ্তানি হচ্ছে। চলতি মৌসুমে বিভিন্ন জেলার ব্যবসায়ীরা এখানকার হাটবাজার থেকে সুপারি কিনে নিয়ে যান। সুপারি ঘিরে আয় বেড়েছে বেকার তরুণ ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদেরও। তারা গ্রামে গ্রামে ঘুরে চাষিদের কাছ থেকে সংগ্রহ করছেন সুপারি। পরে তা বাজারে এনে বিক্রি করছেন বেশি দামে।
টুনিরহাট ভান্ডারুগ্রাম এলাকার হামিদার রহমান জানান, ১০ একর জমিতে বিশাল সুপারির বাগান তার। গত বছর এই বাগান থেকে প্রায় ৫০০ কাহন (এক কাহন= ১৬ পণ, এক পণ= ৮০ পিস) সুপারি বিক্রি করেছিলেন তিনি। এবার ফলন একটু কম। এখন পর্যন্ত ২০০ কাহনের মত সুপারি বিক্রি করেছেন। আর ২০০ কাহনের মত সুপারি হতে পারে।এর মধ্যে ১০০ কাহন সুপারি মাটিতে পুতে রাখবেন। সবমিলিয়ে এ বছর প্রায় ২৫ লাখ টাকা সুপারি থেকে আয় করবেন তিনি।
হাড়িভাসা এলাকার বিল্লাল হোসেন বলেন, দুই জায়গা জুড়ে আমার সুপারির বাগান রয়েছে। বছরে বাগানের সুপারি বিক্রি করে দেড় থেকে দুই লাখ টাকা আয় হয়। বাগানে তেমন খর নেই। একবার গাছ রোপণ করলে ২০-২৫ বছর পর্যন্ত সুপারি পাওয়া সম্ভব।
ব্যবসায়ী খয়রুল ইসলাম বলেন, মৌসুমের শুরুর দিকে কয়েকটি বাগান কিনে রেখেছিলাম। এতদিন সেগুলো দেখভাল করেছি। এখন বাগানগুলো থেকে পাওয়া সুপারি বিক্রি করছি। এবছরে তুলনামূলক দামও বেশি। আশাকরছি ভালো মুনাফা পাবো।
ব্যবসায়ী নুরুল হক সরকার বলেন, এ এলাকার সুপারির সারা দেশেই চাহিদা রয়েছে। আমি প্রতিদিন বিভিন্ন হাটবাজার থেকে সুপারি কিনে দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করি। বিগত বছরের চেয়ে এবার সুপারির দাম অনেকটা বেশি। বর্তমানে বড় আকারের সুপারি ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা এবং মাঝারি আকারের সুপারি ২০০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত কেনা হচ্ছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক শাহ আলম মিয়া বলেন, পঞ্চগড়ে ৬৫০ হেক্টর জমিতে সুপারি আবাদ হচ্ছে। এ জেলায় প্রায় ৩০ কোটি টাকার সুপারি বেচাকেনা হচ্ছে। সুপারির আবাদ জেলার অর্থনীতিতে নতুনমাত্রা যুক্ত হয়েছে। সুপারি চাষে যেহেতু বাড়তি ঝামেলা ও খরচ নেই, একবার চারা রোপণ করতে পারলে কয়েক বছর ফল পাওয়া যায় ফলে অনেক টাকা আয় করা সম্ভব। আমরা সুপারি বাগান করতে স্থানীয়দের উদ্বুদ্ধ করছি।