নিত্যনতুন দালানকোঠায় বিপদে সেন্টমার্টিন

লেখক: নুরুল করিম রাসেল
প্রকাশ: ৫ years ago

দেবে যাওয়ার শঙ্কা স্থানীয়দের

আবদুর রহমান, সেন্টমার্টিন ঘুরে :

সেন্টমার্টিনে পাকা স্থাপনা নির্মাণে সর্বোচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করেই প্রতিনিয়ত কেয়াবন ধ্বংস করে এবং প্রবাল সরিয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে দালানকোঠা – সমকাল

দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন দিন দিন ইটের দালানকোঠার ভারে বিপন্ন হয়ে পড়েছে। দুই বছর আগে আদালতের নির্দেশনা ছিল- দ্বীপে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা আবাসিক হোটেল ভাঙার। তা বাস্তবায়ন তো দূরের কথা বরং দ্বীপে নিত্যনতুন উঠছে পাকা দালানকোঠা। এভাবে চলতে থাকলে বিশ্বখ্যাত দ্বীপটি হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা।

সরেজমিন দেখা যায়, দ্বীপের জেটিঘাট থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে সমুদ্রসৈকতের তীরে পশ্চিমপাড়ার অবস্থান। সেখানকার বাসিন্দা সাবেক ইউপি সদস্য রশিদ আহমদের ছেলে বেলাল উদ্দিনের তত্ত্ব্বাবধানে শত বছরের সঞ্চিত প্রবাল পাথর সরিয়ে নতুন দালানকোঠা নির্মাণ হচ্ছে। বেশ কয়েকজন শ্রমিক প্রবাল পাথর নিয়ে বানাচ্ছেন প্লটের সীমানাপ্রাচীর।

এভাবে দ্বীপের পশ্চিমপাড়া, মাঝারপাড়া ও কোনাপাড়ায় আরও বেশ কয়েকটি দালানকোঠা নির্মাণ হচ্ছে। শুধু তাই নয়, সৈকতসংলগ্ন এলাকায় হোটেল, মোটেল, রেস্টুরেন্ট ও দোকান নির্মাণের জন্য কেয়াবন ও ঝোপঝাড় ধ্বংস করা হচ্ছে। হোটেলে চলা জেনারেটরের আওয়াজে দ্বীপে চলছে শব্দদূষণ। দ্বীপে অবাধে আহরণ হচ্ছে শামুক-ঝিনুক-পাথর। যে যেভাবে পারছেন, দ্বীপে ঘুরছেন। পুরো এলাকা নিয়ন্ত্রণহীন।

পর্যটন মৌসুমে মানুষের অতিরিক্ত চাপে পানি ও পরিবেশ দূষণের হুমকিতে রয়েছে দ্বীপের প্রায় ৬৮ প্রজাতির প্রবাল।

দালানকোঠা নির্মাণের বিষয়ে বেলাল উদ্দিন বলেন, দ্বীপ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে দালানকোঠা নির্মাণ করছি। দ্বীপে শুধু আমি একা নির্মাণ করছি না, আরও অনেকে দালান নির্মাণ করছেন। তার যুক্তি, বিশাল ভবন নির্মাণ হয়েছে তাতে দ্বীপের ক্ষতি হচ্ছে না, সামান্য এ দালানকোঠা নির্মাণে কী আর ক্ষতি হবে!

দ্বীপের কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, দ্বীপের উত্তরাংশের এক বর্গকিলোমিটার এলাকার মধ্যে গড়ে উঠেছে ৮৪টিরও বেশি হোটেল-মোটেল ও ৩০টি রেস্টুরেন্ট। গত পাঁচ বছরে এ এলাকায় ৫৬টির মতো বহুতল হোটেল তৈরি হয়েছে।

জানতে চাইলে সেন্টমার্টিন ইউপি চেয়ারম্যান নুর আহমদ বলেন, দালানকোঠার ভারে দিন দিন দেবে যাচ্ছে সেন্টমার্টিন। ফলে সামান্য জোয়ারের পানি বাড়লেই দ্বীপের চারদিক ডুবে যাচ্ছে, ভেঙে পড়ছে পাড়। গত দুই বছরে দ্বীপের দক্ষিণপাড়া, হরাবনিয়া, গলাচিপা, জাদির বিল, কোনাপাড়া, উত্তর বিল, পশ্চিমপাড়া, ডেইল পাড়াসহ ১৫টি জায়গার দেড় শতাধিক ঘরবাড়ি ভেঙে গেছে, অন্যত্র চলে গেছেন বাসিন্দারা। তিনি বলেন, শুধু পর্যটন অর্থনৈতিক সুবিধার লোভে একের পর এক ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে দ্বীপ একদিন হারিয়ে যাবে।

এদিকে সেন্টমার্টিনের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় করা রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১১ সালে দ্বীপে পাকা স্থাপনা নির্মাণ বন্ধ এবং নির্মিত সব স্থাপনা উচ্ছেদ করতে সংশ্নিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। এতে দ্বীপটিকে ‘পরিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা’ ঘোষণা করা হয়। নির্দেশনা মতে, সেন্টমার্টিনে ছোট কিংবা বড় কোনো পাকা স্থাপনাই নির্মাণের সুযোগ নেই। কিন্তু তার পরও সেখানে গড়ে উঠছে একের পর এক স্থাপনা।

পরিবেশবিষয়ক সংস্থা ইয়ুথ এনভায়রনমেন্ট সোসাইটির (ইয়েস) কক্সবাজারের প্রধান নির্বাহী ইব্রাহিম খলিল মামুন বলেন, দুঃখজনক হলেও সত্য, দুই বছর আগে দ্বীপে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা আবাসিক হোটেল-মোটেলসহ ১০৬টি ভবন ভাঙার নির্দেশনা থাকলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। আদালতের সুস্পষ্ট নির্দেশনা উপেক্ষা করে সেন্টমার্টিনে গড়ে উঠছে নানা স্থাপনা। এ বিষয়ে সরকারের কঠোর পদক্ষেপ প্রয়োজন।

টেকনাফের ইউএনও রবিউল হাসান বলেন, সেন্টমার্টিনে নতুন কোনো দালানকোঠা নির্মাণ করতে দেওয়া হবে না। এ বিষয়ে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আগে যেসব হোটেল-মোটেল ভাঙার নির্দেশনা ছিল, সেসব হোটেল মালিক আদালতে আপিল করেছেন। তবে আদালতের নির্দেশ বাস্তবায়নে কাজ করছি আমরা।

পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজার কার্যালয়ের উপপরিচালক মোহাম্মদ নুরুল আমিন বলেন, সেন্টমার্টিনে নতুন করে দালানকোঠা নির্মাণের সুযোগ নেই। যারা দ্বীপে এসব কাজ করছে, তাদের বিরুদ্ধে পরিবেশ আইনে মামলা করা হবে।

কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) ফুরকান আহমেদ বলেন, সেন্টমার্টিন নিয়ে সরকারের নির্দেশনা রয়েছে। সেগুলো কেউ অমান্য করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।