রাজেকুজ্জামান রতন : ভোক্তা অধিকার দিবস পালিত হলো। ভোক্তাদের আছে ভুক্তভোগী হওয়ার অধিকার। একটা কথা খুব বেশি শোনা যায় যে, বাজার নিয়ন্ত্রণ সরকারের একার দায়িত্ব নয়। সরকারের উচ্চমহল, ক্ষমতাসীন দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতা, সরকারের দায়িত্বপূর্ণ দপ্তরের দায়িত্বপূর্ণ কর্মকর্তা সবার কণ্ঠে একই সুরে বলা হচ্ছে এই কথা। মাঝে মাঝে অবশ্য এমন কথাও শোনা যায় যে, বাজার অস্থিতিশীল করার ব্যাপারে সরকারবিরোধীদের ভূমিকা আছে। তাহলে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে দায়িত্বটা কার?
কেন ভোক্তারা আশা করে দ্রব্যমূল্য কমুক? কারণ দাম বাড়লে তার ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। যে মানুষের মাসিক আয় ২০ হাজার টাকা সে চাইলেই আয় বাড়াতে পারবে না। অথচ চাল, ডাল, তেল, মাছ, মাংস, লবণ, চিনি সবকিছুর দাম বেড়েছে এবং বাড়ছে। তখন সে কী করবে? সে সরকারকে দায়ী করে কিছু করছে না বলে আর নিজেকে দায়ী করে আয় বাড়াতে পারছে না বলে। কিন্তু ব্যবসায়ীকে বা বিক্রেতাকে কিছু বলতে পারে না সে অসহায় বলে। এর প্রভাব কি সমাজে পড়ে না? অবশ্য পড়লেই বা কী! যারা ক্ষমতায় আছেন তারা উদাহরণ দেন অতীতের, ইউরোপের এবং বর্ণনা দেন নিজেদের কর্মতৎপরতার।
বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির হার নিয়ে সরকারি যে পরিসংখ্যান পাওয়া যায়, তা বাজারে গেলে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না। সাধারণ মানুষ প্রতি মাসে বাজার থেকে যে ৬০টি পণ্য কিনে থাকে, গড়ে সেগুলোর দাম বেড়েছে ২০ শতাংশ। এই ৬০টির মধ্যে অনেক পণ্য আছে যেগুলোর দাম সামান্য বেড়েছে ৫-১০ শতাংশ। আবার বাজারের তালিকায় এমন পণ্য আছে যেগুলোর দাম বেড়েছে অত্যধিক, অর্থাৎ ৩০-৪০ শতাংশ।
বাজারে জিনিসপত্রের দাম চড়া, এটা এখন কোনো খবর নয়। নিয়ন্ত্রণহীন দ্রব্যমূল্য দীর্ঘদিন ধরেই। কিন্তু রমজান মাসে মানুষ যখন রোজা রাখে তখন দ্রব্যমূল্য যেন লাগামহীন ঘোড়ার মতো। দৌড়ানোর পথে যা পায়, সব মাড়িয়ে ছুটছে ঘোড়া। সরকার বলছে, রমজানে দাম বাড়ানো চলবে না আর ব্যবসায়ীরা বলছে, ‘মজুদ পর্যাপ্ত, বাড়বে না দাম’। কিন্তু মানুষ দেখছে দাম বেড়েই চলেছে। বাজারে গিয়ে ক্রেতা দেখেন বাজার গরম! এবং বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, যা শুনেছে তা সবই ফাঁকা প্রতিশ্রুতি। এটা শুধু এবারই নয়, কোনো রোজাতেই ব্যবসায়ীদের কথার আর সরকারের প্রতিশ্রুতির সঙ্গে কাজের মিল খুঁজে পান না ভোক্তা। এবার রমজান ঘিরে কেন তার ব্যতিক্রম হবে? একই পথে হাঁটছেন ব্যবসায়ীরা আর ভোগান্তি সইবেন সাধারণ মানুষ। মানুষ খুঁজবে সরকারকে আর প্রশ্ন তুলবে বাজার সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণ করার কেউ কি নেই?
ইউক্রেন যুদ্ধের অজুহাত তো ছিলই, এর বাইরে নানা অজুহাতে কয়েক মাস ধরেই বাজারে সব নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি অস্বাভাবিক আর বাজার টালমাটাল। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নতুন উপলক্ষ রোজা। ফলে সপ্তাহ দুয়েক ধরে বাজার আরও আকাশচুম্বী। নিত্যপণ্যের সঙ্গে ইফতারির উপকরণের দাম বাড়ার যন্ত্রণায় পুড়ছেন এবং পুড়বেন নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির ভোক্তারা। অর্থনীতির চাহিদা জোগান তত্ত্ব না বুঝলেও মানুষ এটা ধরে নিয়েছে যে, সরকারের দুর্বল এবং ব্যবসায়ী সহায়ক ভূমিকার কারণে রমজান ঘিরে ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফার ইচ্ছায় লাগাম টানা যায়নি। এ জন্য যতই হুমকি-ধমকি দেওয়া হোক না কেন, তারা নিজস্ব ছকে নিয়ন্ত্রণ করে বাজার।
শসার দাম দ্বিগুণ আর লেবুর দাম তিনগুণ শুনে, এ কথা ভাবার কোনো কারণ নেই যে, এর সুফল কৃষকরা পাবেন। লেবুর এমন দাম দেখে নাকি হতভম্ব হয়েছেন খোদ বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী। ঢাকার মোহাম্মদপুর টাউন হল বাজার ঘুরে কাঁচাবাজার বণিক সমিতির নেতাদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, ‘এখানে দেখলাম এক হালি লেবুর দাম ৬০ টাকা। তাতে একটির দাম পড়ে ১৫ টাকা। অথচ একটু আগে আমার নির্বাচনী এলাকা টাঙ্গাইলে ফোন করে জানলাম, সেখানে পাইকারিতে প্রতিটি লেবু ৫ থেকে ৬ টাকা বিক্রি হচ্ছে। অর্থাৎ ১০০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে ঢাকায় এসে একটা লেবুর দাম হয়ে যাচ্ছে তিন গুণ।’ বাণিজ্যমন্ত্রী যা বলেছেন এবং যেখানে বলেছেন তা কি দাম কমানোর ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা রাখবে? এ রকম তথ্য তো সাংবাদিকরা অহরহই দিচ্ছেন।
রমজানে যাদের সামর্থ্য আছে সেসব মানুষ বেশি খায় ছোলা, খেজুর, চিনি, তেল, বেগুন, শসা আর মাছ-মাংস। এর তো একটা হিসাব আছে। ছোলার দাম বেড়েছে কেজিতে ৩০ টাকা। বছরে খেজুরের চাহিদা রয়েছে প্রায় এক লাখ টন। দেশে উৎপাদন না হওয়ায় চাহিদার পুরোটাই আমদানি হয় মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার কয়েকটি দেশ থেকে। মোট চাহিদার অর্ধেক অর্থাৎশুধু রমজানে দরকার হয় ৫০ হাজার টন। টাকার দাম কমে যাওয়া আর ডলারের দর বাড়ার পাশাপাশি খেজুরে বিরাজমান উচ্চ শুল্ক দাম বাড়ানোর যুক্তি হিসেবে হাজির করেছে ব্যবসায়ীরা। খেজুর আমদানিকারকদের দাবি, সাধারণ মানের এক কেজি আমদানিতে ১৪০ টাকার মতো শুল্ক দিতে হচ্ছে। ফলে বাজারে এর প্রভাব পড়বেই। রমজানের আগে গত এক মাস ধরেই বাড়তি দরে বিক্রি হচ্ছে খেজুর। সরকার শুল্ক কমালেও তার প্রভাব নেই বাজারে। নিম্ন আয়ের মানুষ সাধারণত কম দামি খেজুর খেয়ে থাকেন। গত বছরের ১৪০ থেকে ১৬০ টাকার দরের সাধারণ মানের বা জায়েদি খেজুর এবার কিনতে হচ্ছে ২৬০ থেকে ২৮০ টাকায়। উন্নতমানের খেজুরের দাম বেড়েছে আরও বেশি। মরিয়ম ও আজওয়া খেজুরের কেজি গত বছর ছিল ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা। দাম বেড়ে এ বছর বিক্রি হচ্ছে ১০০০ থেকে ১২০০ টাকায়। এ ছাড়া খুরমা ও দাবাস খেজুর কেজিতে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৪০০ থেকে ৫৫০ টাকায়। টিসিবি বাজারদর হিসাব করে বলেছে, খেজুরের দাম এক বছরে বেড়েছে ২২ শতাংশ। দাম বেড়েছে এ কথা বলাটুকুই যেন টিসিবির দায়িত্ব!
অবস্থা দেখে মনে হয়, দেশের ব্যবসায়ীরা মনে করেন, রমজান তাদের মুনাফার মাস। তাদের সর্বোচ্চ লক্ষ্য থাকে কীভাবে ১১ মাসের মুনাফা তারা এক মাসে করবেন। রমজানে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখার নামে সরকার থেকে তারা নানা সুবিধা নিয়ে থাকেন। কিন্তু ফলাফল শূন্য, দাম বেড়েই চলে। আর একটা কথা চালু হয়েছে যে, অসাধু ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়ে থাকেন। তাহলে প্রশ্ন উঠতেই পারে, এ ক্ষেত্রে সাধু ব্যবসায়ীদের ভূমিকা কী? আসলে সাধু-অসাধু বিষয় নয়, ব্যাপারটা হচ্ছে ব্যবসায়ীদের ক্ষমতা আর সরকারের আনুকূল্য। ফলে দু-একটা লোকদেখানো পদক্ষেপ নিলেও তেমন কার্যকর কোনো ব্যবস্থা কারও বিরুদ্ধে নেওয়া হচ্ছে না। তাতে তারা বুঝতে পেরেছেন, এসব হুমকি-ধমকিতে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। বাজার চলবে ব্যবসায়ীদের ইচ্ছার গতিতে।
সরকারি মন্ত্রী-এমপিদের মতো জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বাজার নিয়ন্ত্রণে ভোক্তাদের কিছু পরামর্শ দিয়েছেন। তার মতে, বাজার নিয়ন্ত্রণ সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয়। শৃঙ্খলা আনতে হলে, প্রতিটি বাজারের কমিটিকে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে। এ জন্য সবাইকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। তিনি বলেন, ভোক্তাদেরও সচেতন হতে হবে। একসঙ্গে অতিরিক্ত পণ্য কেনা থেকে বিরত থাকতে হবে। ঘরে অযথা মজুদ না বড়িয়ে প্রয়োজন অনুযায়ী কিনতে হবে। বেশ ভালো পরামর্শ! কিন্তু দেশের ৭ কোটি ৩৬ লাখ শ্রমশক্তি যাদের বিপুল সংখ্যকের মাসিক আয় ১৫ হাজার টাকার নিচে, তাদের কি ক্ষমতা আছে অতিরিক্ত পণ্য কেনার? মাসে ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা আয় করেন যারা বাসা ভাড়া, বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাসের বিল দেওয়ার পর তাদের হাতে কি এমন পরিমাণ টাকা থাকে যে, অতিরিক্ত পণ্য কিনতে পারবেন? তাহলে এই পরামর্শ কাদের জন্য? যাদের সামর্থ্য নেই, তাদের কাছে এই পরামর্শ অবাস্তব আর যাদের সামর্থ্য আছে তাদের জন্য এ ধরনের পরামর্শ অপ্রয়োজনীয়। বাজার নিয়ে এই অস্থিরতার মধ্যে আবার সমন্বয়ের নামে বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুতের দাম। ফলে সামগ্রিক মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পড়ছে দরিদ্র, নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের জীবনে।
সাধারণ হিসেবে দেখা যায়, ৫ সদস্যের একটি পরিবারে মাসে ব্যয় বৃদ্ধি হচ্ছে প্রায় দুই হাজার টাকা। কোথা থেকে আসবে এই টাকা। তারা কি দুর্নীতি করবেন? চাইলেই কি সবাই দুর্নীতি করতে পারবেন? তাহলে উপায়? পথ একটাই, খরচ কমানো। বিবিএসের জরিপে দেখা যাচ্ছে, দেশের মানুষের চাল এবং ডিম খাওয়া কমেছে। রমজান উপলক্ষে খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি তাদের পাত থেকে আরও খানিকটা খাবার কমিয়ে দেবে কি? রোজার অজুহাতে বাজারকে অস্থির করে সাধারণ মানুষের স্বস্তি কেড়ে নেওয়া তো চলছেই। সরকার সজাগ আছে, তৎপর আছে- এসব ঘোষণা মানুষ শুনছে। কিন্তু ঘোষণার ফল রোজার প্রথম সপ্তাহে মানুষ দেখেনি, এরপরও দেখবে সে আশা খুবই ক্ষীণ। একে তো দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি জীবনকে বিপন্ন করছে তার সঙ্গে যদি বিকল্পের নামে উদ্ভট পরামর্শ দেওয়া হয়, তাতে মানুষ আরও হতবাক হয়ে যায়। একদিকে রাষ্ট্রের প্রধান মজুদদারদের সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলছেন, এরা পণ্য পচিয়ে ফেলবে তবু সস্তায় বিক্রি করবে না। অন্যদিকে যাদের দায়িত্ব এসব মজুদদারকে ধরা বা নিয়ন্ত্রণ করা তারা বলছেন, জনগণেরও কিছু দায়িত্ব আছে। জনগণের দায়িত্ব কি তাও তারা বলে দিয়েছেন, প্রথম দায়িত্ব কম কেনা, কম খাওয়া। দ্বিতীয় দায়িত্ব বিকল্প খুঁজে বের করা। আর তৃতীয় দায়িত্ব, দাম বাড়লেও খেতেই হবে এই মানসিকতা পরিহার করা। প্রয়োজনে খাবেন না তারপর দেখুন দাম কমে কি না! মানুষের সামর্থ্য না থাকলে মানুষ খায় না, কেনে না এই নিয়মে তো মানুষ অভ্যস্ত। ফলে সেই পরামর্শ দেওয়ার জন্য ট্যাক্সের পয়সা খরচ করে মন্ত্রী, আমলার বেতন ভাতা দিতে হবে কেন? এই প্রশ্ন জনগণ করতে শুরু করেছে ইতিমধ্যেই।
লেখক: রাজনৈতিক সংগঠক ও কলাম লেখক
rratan.spb@gmail.com