আমান উল্লাহ আমান, টেকনাফ প্রতিনিধি, দৈনিক মানবজমিন ॥
মিয়ানমারের আরকান রাজ্যে সহিংসতার পাঁচ মাস পেরিয়ে গেলেও সেখানের পরিস্থিতির শান্ত হয়ে আসেনি। তীব্র খাদ্য সংকট, পুরুষদের ধরে নিয়ে নির্যাতন ও বিনা বেতনে শ্রম কাটানো, কাজের জন্য ঘর থেকে বের হতে না দেওয়া, দিনের পর দিন বাড়ী ঘরে অগ্নিসংযোগ করে যাচ্ছে বর্মী সেনা ও মগরা। এমন নানা অভিযোগে প্রতিদিন সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে পালিয়ে আসছে রোহিঙ্গারা। এসব রোহিঙ্গাদের এদেশে পালিয়ে না আসতে সেনারা বাধা ও নিষেধ করছেন বলে আগত রোহিঙ্গারা জানিয়েছেন। ৬ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার প্রায় দুই শতাধিক রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ ও শিশু আরকান রাজ্য থেকে পালিয়ে ছোট ছোট ইঞ্জিন চালিত ফিশিং বোট করে টেকনাফের মহেশখালীয়া পাড়া ও নোয়াখালী পাড়া সৈকত পয়েন্ট দিয়ে এপারে ঢুকেছে। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা বুছিডং থানার ছিন্দিপ্রাং, ছিংদং, উলাফে, আলিশাং, পুঁইমালি, সামিলা পাড়ার বাসিন্দা। পালিয়ে আসা বুছিডংয়ের ছিংদং গ্রামের মৃত আশরাফ মিয়ার পুত্র আবুল বাছের (৪৮) জানান, গত ২ ফেব্রুয়ারি ভোরে প্রায় ২’শ রোহিঙ্গা মুসলিম একসাথে এদেশে (বাংলাদেশে) পালিয়ে আসতে ঘর থেকে রওয়ানা করে। প্রায় দুই ঘন্টা পর্যন্ত হাঁটার পর পাহাড়ের কাঁছাকাঁিছ পৌঁছলে বর্মী সেনারা তাদের বাঁধা দেয়। সেনারা তাদের কাছে বাংলাদেশে পালিয়ে আসার কারণ জানতে চাই। এসময় রোহিঙ্গারা ‘ঘর থেকে বাহির হতে না দেওয়ায় কাজ কর্ম করতে না পেরে খাদ্য সংকট, পুরুষদের ধরে নিয়ে নির্যাতন ও বিনা বেতনে শ্রমিক কাটানো, দিনের পর দিন বাড়ী ঘরে অগ্নি সংযোগসহ নানা অভিযোগ তুলে ধরে’। এর উত্তরে বর্মী সেনারা তাদেরকে এদেশে (বাংলাদেশ) না আসতে নিষেধ করে জানায়, ‘রোহিঙ্গা মুসলিমদের জন্য আশ্রয় শিবির তৈরী করা হয়েছে, সবাইকে সেখানে নিয়ে যাওয়া হবে’। সেখানে ঘন্টা দুয়েক আটকে রাখার পর বিকালের ৪ টার দিকে ছেড়ে দেওয়া হয়। এভাবে পালিয়ে আসার পথে বিভিন্ন স্থানে বর্মী সেনারা তাদের বাঁধা প্রদান করে। প্রায় ৩ তিন দিন হাঁটার পর ধংখালী সীমান্তে পৌঁেছ কাঁটা তারের ঘেরা অতিক্রম করে। সেখান থেকে ইঞ্চিন চালিত ফিশিং বোটে করে এপারে চলে আসে। তারা একসাথে ৫ টি বোটে রাত ১১ টার দিকে জনপ্রতি ৫০ হাজার কিয়াতের বিনিময়ে সাগর পথে রওয়ানা দিয়ে ভোর রাত ৫ টার দিকে সৈকত পয়েন্ট দিয়ে এপারে উঠে। প্রতিটি নৌকায় ২৫ থেকে ৩০ জন করে নারী, পুরুষ ও শিশু রয়েছে। ওলাফে গ্রামের বাসিন্দা মোঃ ফায়সাল (২০) জানান, প্রতি মুহুর্ত আতংক আর অর্ধহারে অনাহারে ঘরে বসে থাকতে হয়। মাঝে মধ্যে ঘরবাড়ীতে অগ্নি সংযোগ করে ভয়ভীতি দেখায়। পূরুষদের ধরে নিয়ে সেনাদের ব্যারাকে বিনা বেতনে শ্রমিক হিসেবে ব্যবহার করে। আরফা বেগম (৩৫) জানায়, ধংখালী পয়েন্টে এখনো ৫/৬ শতাধিক রোহিঙ্গা নারী পুরুষ এপারে আসতে অপেক্ষামান রয়েছে। অর্থ ও বোট সংকটের কারনে তারা এপারে আসতে পারছেনা। এদিকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের একটি অংশ টেকনাফ পৌর স্টেশনের আবু ছিদ্দিক মাকের্টে এসে জড়ো হয়। সেখানে পুলিশের বিশেষ টহল দলের সদস্যরা তাদের তালিকাভ’ক্ত করে ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেয়। কিছু রোহিঙ্গা নিজেরাই আত্মীয় স্বজনের সহযোগীতায় বিভিন্ন ক্যাম্পে চলে যায়। এখানে দায়িত্বরত এএসআই আমিনুর জানান, সকাল সাড়ে ১০ টা পর্যন্ত ৫৩ জন রোহিঙ্গাকে এখান থেকে বিভিন্ন ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। নৌকায় এক শিশুর মৃত্যু মিয়ানমার হতে পালিয়ে আসতে গিয়ে রোহিঙ্গা বোঝাই নৌকাতে এক শিশুর মৃত্যু ঘটেছে। ৬ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার সকালে টেকনাফের উপকূলীয় বাহারছড়া ইউনিয়নের নোয়াখালী পাড়া এলাকায় সৈকত পয়েন্ট দিয়ে আসা রোহিঙ্গা বোঝাই নৌকাতে আনুমানিক ৭-৮ বছরের শিশুটির মৃত্যু হয়। স্থানীয়দের সহযোগীতায় রোহিঙ্গা শিশুটিকে তাকে টেকনাফ বাহারছড়ার বাগঘোনা এলাকায় দাফন করা হয়েছে। স্থানীয় ইউপি মেম্বার মোঃ ইলিয়াছ জানান, ঠান্ডাজনিত কারণে শিশুটির মৃত্যু হয়েছে বলে তিনি শুনেছেন। টেকনাফ মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোঃ মাঈন উদ্দিন খান সংবাদের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।