আজিজ উল্লাহ : অপরূপ প্রাকৃতিক লীলাভূমি বাহারছড়া একদিকে সবুজ অরণ্যের পাহাড় অন্যদিকে দিগন্ত বিস্তৃত ঝাউবন ও অন্তহীন সমুদ্রের তীরে গড়ে উঠা উপকূলীয় বাহারছড়াকে অনন্য, দর্শনীয় করে তুলেছে সুদীর্ঘ সমুদ্রের পাড় ঘেঁষে বেয়ে চলা কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিনড্রাইভ। এই স্বপ্নের মেরিনড্রাইভের বেশিরভাগ অংশ প্রায় ২৮ কিলোমিটার রয়েছে বাহারছড়াকে কেন্দ্র করে।শুধু কি তাই? এখানে সবুজ রঙের সুপারি বাগানের আঁকেবাকে পাহাড়ি নদীর বয়ে চলেছে এলজিডি রোডও তার সাথে একে আরো মনোরম পরিবেশে রূপায়ন করেছে চির যৌবনা বিশাল পাহাড়ের পাদদেশে সারি সারি সুশৃঙ্খল বিন্যাসে দাঁড়িয়ে থাকা মনভুলানো দৃষ্টি প্রসারিত জাহাজপুরা গর্জন বাগান যেখানে ভোরের আলো প্রসারিত ও সূর্যাস্ত লগ্নে পাখি কিচির মিচির ডাক মৌমাছির গুঞ্জন শব্দে মুখরিত করে পুরা পরিবেশকে। এছাড়া বাহারছড়ার সবচেয়ে ঐতিহ্যমন্ডীত সুপারির সুনাম যেটা সারা দেশে টেকনাফকে বিখ্যাত রুপে পরিচিতি করেছে সেই বিশাল সুপারির বাগানেও রয়েছে বাহারছড়ায়।হয়তো সেইসব বিখ্যাত সুপারির বাগানের গল্প বাদ দিয়ে এখন টেকনাফে অন্য গল্প রুপধারন করছে যে গল্প মাথা উঁচু করে দাড়ার কিংবা সন্মানের গল্প নয় যেটা মাথা নিচু করার গল্প সম্মান হানির গল্প।বর্ষা মৌসুমে আউস ও বুরো ধানে বিস্তীর্ণ বিশাল এই এলাকাকে যেন সবুজের চাঁদর মনে হয় আর যখন ধান পাঁকা শুরু হয় তখন সোনালী ফসলের ভারি ভারি ছরা দেখে কৃষকের দীর্ঘদিনের কষ্ট ম্লান হয়।
সামাজিক দিক থেকে বাহারছড়া মানুষের রয়েছে অটুট সামাজিক বন্ধন যেখানে বিশাল জনগোষ্ঠীর সিংহভাগ মানব ইসলাম ধর্মাবলম্বী তাছাড়াও হিন্দু চাকমা সম্প্রদায় সেখানে হিন্দুরা মুসলমানদের সাথে মিলে মিশে সমতল ভূমিতে পাশাপাশি বাস করলেও চাকমা উপজাতি পাহাড়ের পাদদেশে বাস করে।এই তিন জাতিতে সম্প্রতির বন্ধন অনেক বলিয়ান বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসবে তারা একে অপরের সাথে ভাগাভাগি করে আনন্দ উপভোগ করে।তবু এখানে বড় একটা নজির রয়েছে কোনদিন সম্প্রদায়িক ডাঙা-হাঙ্গা হতে দেখিনি। যদিও আমাদের পাশ্ববর্তী এলাকা হোয়াইক্যং মন্দিরে আগুন দেওয়ার মত ঘটনা ঘটেছে সেরকম কোন ঘটানা ধর্মকে কেন্দ্র করে বাহারছড়া সংঘটিত হয়নি। বাহারছড়াও মানববিধ্বংসী মাদকের করাল অভিশাপ গ্রাস করতে বসেছে।ভুলপথে জড়িয়ে পড়েছে অনেক তরুণ, যুবক, বৃদ্ধ, ছাত্র সমাজ।এইভাবে উপকূলীয় অঞ্চল বাহারছড়া মাদকের অভিশাপের দারপ্রান্তে নিমজ্জিত হচ্ছে।
অর্থনৈতিক দিক থেকেও বাহারছড়া অর্থনৈতিকভাবে দূরন্ত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে এখানে অর্থ উপার্জনের মূল উৎস হচ্ছে বঙ্গোপসাগর মাছ শিকারের পাশাপাশি রয়েছে চিংড়ি মাছের পোনা আহরণ করা,সুপারির বাগান, পানের বরজ,তরমুজ ক্ষেত,পাহাড়ে জুম চাষ,বিভিন্ন ক্ষেত খামার, বর্ষায় মাছের ফিশারিসহ অনেক প্রাকৃতিক সম্পদের উৎস রয়েছে।তাতে বাহারছড়া জনমানব প্রাকৃতিক সম্পদকে কাজে লাগিয়ে সুখ শান্তিতে বসবাস করে আসছে।
টেকনাফের রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও উপকূলীয় বাহারছড়ার তুলনাহীন গুরুত্ব ও মূল্য রয়েছে। এখানে সংসদ নির্বাচন, উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে বরাবরই স্পষ্টভাবে ভূমিকা রাখে বাহারছড়ার ভোটরা। উপজেলা নির্বাচনে যেকোন প্রার্থীকে জিতাতে ভোট ব্যাংক হিসাবে বাহারছড়ার জনগণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।দেশের অন্যান্য জায়গায় তুলনায় এখানে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা প্রায় নাই বললে চলে সকল রাজনৈতিক দলের সদস্যদের একসাথে বসে আড্ডা দিতেও দেখা যায়।উপকূলীয় এলাকার মানুষ এখন রাজনৈতিকভাবে মোটামুটি সচেতন।
শিক্ষাক্ষেত্রে এক সময়ের টেকনাফ উপজেলার বাহার ছড়া নামের অজপাড়াগাঁ নামের গ্রামটি আজ শিক্ষা-দীক্ষায় বিদ্যুৎ গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে।এই অজপাড়াগাঁয়ের ছেলে-মেয়ে দেশের স্বনামধন্য বিদ্যাপিঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়সহ সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন মেডিকেল কলেজের গন্ডি পেরিয়ে লন্ডনে গিয়ে ব্যারিস্টারি,চাইনাতে ডাক্তারি পড়াসহ ভালো কলেজ পড়াশোনা করে আসছে এই অজপাড়াগাঁয়ের ছেলেমেয়ে। যদিও বাহার ছড়া নেই কোন উচ্চমাধ্যমিক কলেজ,মাদ্রাসা।এরই মাঝে সচেতন গার্ডিয়ান এবং সচেতন ছাত্রদের নিজ প্রচেষ্টায় এগিয়ে যাচ্ছে বাহারছড়ার পুলাপাইন। বাহার ছড়া শিক্ষার আলোর প্রদীপ জ্বালাতে অগ্রগামী পথিক ছিলেন উত্তর শিলখালী তাফহিমুল কোরআন দাখিল মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠাতা মৌলভী মকসুদল আলম, শিক্ষানবিশ মাস্টার এমএ মনজুর ভূমিকা অনস্বীকার্য।এর পর বর্তমান অনেকে ব্যাক্তিগত উদ্যোগে বিভিন্ন স্কুল, নুরানি মাদ্রাসা, সরকারি মাদ্রাসা হেফজখানীসহ বিভিন্ন বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শিক্ষা উন্নয়নে অবদান রাখতেছে।
সামাজিক সমস্যাবলির কথা যদি বলি প্রতিটি সমাজে প্রতিটি এলাকায় সাধারণত কিছু না কিছু সমস্যা বিদ্যামান থাকে বাহারছড়াও তার ব্যতিক্রম নয় এখানেও বিভিন্ন ধরনের সামাজিক জামেলা রয়েছে। বাহারছড়াও টেকনাফের একটি অংশ দেশের সবচেয়ে আলোচিত মাদকের স্বর্গরাজ্য হিসাবে পরিচিত এই জনপদের বাহারছড়াতেও মাদকের অভিশাপ কম বেশি গ্রাস করেছে। মাদক পাচারের মূল কেন্দ্র বিন্দু হিসাবে ভূমিকা রেখেছে মেরিনড্রাইভ।এখানে প্রধান সমস্যা মাদকের পাশাপাশি রয়েছে সরকারি বন উজাড় করা, সমুদ্রের তীরের ঝাউবন এবং উল্লেখ্যযোগ্য সমস্যার মধ্যে জটিল সমস্যা হচ্ছে মানুষের দীর্ঘদিনের বসবাসরত জমি জোরপূর্বক দখল করে নেয়াকে বলা যেতে পারে।মেরিনড্রাইভ হওয়ায় আচমকা বিস্ময়কর উপায়ে উপকূলীয় জমির দাম শতগুণে বেড়ে যায়, যে জমি গত ১০-১২ বছর আগে প্রতি কানি ৪০ হাজার টাকা দাম ছিল সেই একই জমি এখন ৩০-৪০ লাখ টাকা দামে বিক্রি হচ্ছে এমনি উপকূলের প্রায় জমি বিক্রি হয়ে গেছে কিন্তু এই একসময়ের অজপাড়াগাঁয়ে বসবাসরত মানুষ ছিল অসচেতন জমির দলিলাদি তেমন বুঝত না পড়তেও পারত না তাই একজনের দখলীয় জমি অন্যজনে বেদখলি বেশি টাকার লোভে দাললের খপ্পরে পড়ে বিক্রি করে দিচ্ছে।অনেক বিক্রিতা জানেও না তার তার সরলতার সুযোগ নিয়ে দলিলে দুটি আঙুলের টিপে তার শতবছর বসত ভিলা মিথ্যার আশ্রয়ে দালাল নিয়ে নিচ্ছে।শুধু তাই নয় বাহার ছড়া বিভিন্ন বংশের মাঝে হানাহানি মারামারি সামাজিকভাবে সম্পর্ক ছিন্ন বিচ্ছিন্নসহ হিংসা বিদ্বেষের অন্যতম কারণ হচ্ছে জমি সংক্রান্ত বিষয়ে।রাজনৈতিকভাবে যদি বলি বাহার ছড়া রাজনৈতক তেমন সমস্যা নেই।
বাহার ছড়া নির্বাচিত স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিরা তেমন শিক্ষিত নয় তারা মানুষের অধিকারের তেমন সচেতন নয় এমনটা বলা যায়।জনপ্রতিনিধি সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করলে কিছু টা হলেও মাদক, জমি দখল, ঝাউগাছ নিধন পাহাড় কাটা, বনের গাছ কাটাসহ বিভিন্ন অপরাধ একটু হলেও লাগব হতো। এমনি এখানকার স্থানীয় প্রশাসনের জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে মাদকের সাথে জড়িতের অভিযোগ আছে।ফলে জনপ্রতিনিধিরা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারছে না।সুশিক্ষিত সুনাগরিক জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হলে এই পর্যটন সম্ভাবনানয় বাহারছড়া অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক শিক্ষা দীক্ষা আরো এগিয়ে যাওয়ার সম্ভবনা রয়েছে।
এই সব সমস্যা সমধান যা উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে সেগুলি নিচে প্রদত্ত
*সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে জনসচেতনতামূলক মাদকের বিরুদ্ধে সাপ্তাহিক কর্মশালার আয়োজন করা।
* মাদকের বিরুদ্ধে নিজ নিজ পরিবারকে সচেতন করা।
* প্রতিটি স্কুল মাদ্রাসায় ছাত্র-ছাত্রীদের মাদকের ক্ষতিকর বিষয়ে সচেতন করা।
*প্রতি সাপ্তাহে জুমার খুৎবায় ইসলামের আলোতে মাদকের বিরুদ্ধে সচেতনমূলক আলোচনা করা।
*নিজে মাদককে ঘৃণা করে মাদক কারবারিদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা।
*মাদক কারবারে জড়িত পরিবারের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ না হওয়া।
* মাদকের বিরুদ্ধে প্রশাসনকে সঠিক তথ্য দেয়া।
*ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকে নিরপরাধ কাউরো বিরুদ্ধে প্রশাসনকে ভুল তথ্য না দেয়া।
*ঈদ কোরবানের সময় দেশের বিভিন্ন বিদ্যালয়ে অধ্যায়নকারী শিক্ষার্থীদের এক সাথে হয়ে মাদকের বিরুদ্ধে জনগণকে সচেতন করা।
*জমির দালালদের সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে যাতে গরীব অসহায় নিরক্ষর মানুষের জমি জোরপূর্বক উচ্ছেদ না হয়।
*উপকূলীয় বিজিবি বিশেষ করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সরকারের নাম দিয়ে তারদের পছন্দের জমি দখল করার চেষ্টা করে আসছে।
*সমুদ্র তীরে যেখানে ঝাউগাছ কর্তন করা হয়েছে তাতে নতুন করে ঝাউগাছ লাগোর ব্যবস্থা করা।
* জাহাজপুরা বিশাল পাহাড় বেষ্টিত গর্জন বাগানকে পর্যটন শিল্পের আবরণে তুলে ধরা।
*পূর্ব পাহাড়ে সরকারি বনায়নের ব্যবস্থা করা।
আজিজ উল্লাহ শান্ত, ইতিহাস বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।