টেকনাফ টুডে ডেস্ক :
ছেলে ধরা সন্দেহে রাজধানীর উত্তর বাড্ডা, নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ ও কেরানীগঞ্জে গণপিটুনিতে নারীসহ তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। শনিবার সকালে উত্তর বাড্ডায় এক নারী ও সিদ্ধিরগঞ্জে এক যুবক এবং শুক্রবার রাতে কেরানীগঞ্জে এক যুবক মারা গেছে।
এছাড়া শনিবার গাজীপুরে এক নারী ও শুক্রবার চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গায় এক বৃদ্ধকে মারধর করা হয়েছে। এদিকে গণপিটুনি দিয়ে মানুষ মারাকে বড় ধরনের অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করে তা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছে পুলিশ সদর দফতর। শনিবার বিকালে এক বার্তায় এ আহ্বান জানানো হয়।
রাজধানীর উত্তর-পূর্ব বাড্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শনিবার সকাল ৯টার দিকে যান এক নারী। এ সময় স্কুলের সামনে থাকা অভিভাবকরা তাকে স্কুলে প্রবেশের কারণ জানতে চান। সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করাবেন বলে ওই নারী জানান। এরপর তাকে প্রধান শিক্ষিকার কক্ষে নেয়া হয়।
তবে খবর ছড়িয়ে পড়ে স্কুলে ছেলে ধরা এসেছে। এরপর ছেলেধরা সন্দেহে তাকে স্কুলের বাইরে এনে গণপিটুনি দেয়া হয়। পুলিশ তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
বাড্ডা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রফিকুল ইসলাম বলেন, স্কুলে প্রবেশের পর ওই নারীর নাম-পরিচয় জানতে চাওয়া হয়। তিনি বাসার ঠিকানা একেকবার একেকরকম দেয়ায় সন্দেহ হয়। এতে খবর ছড়িয়ে পড়ে শিশুদের ধরতে স্কুলে লোক এসেছে। এর কিছুক্ষণ পর তাকে ছেলে ধরা সন্দেহে স্কুলের বাইরে এনে গণপিটুনি দেয়া হয়।
তিনি আরও জানান, পুরো ঘটনাটি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। নিহত নারীর নাম তাসলিমা বেগম রেনু (৪০)। তার গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুর জেলার রায়পুর উপজেলায়। তিনি ঢাকার মহাখালীতে পরিবারের সঙ্গে থাকতেন। সিদ্ধিরগঞ্জ (নারায়ণগঞ্জ) : সিদ্ধিরগঞ্জের মিজমিজির আল আমিন নগর ও পাইনাদীতে দুটি গণপিটুনির ঘটনা ঘটে। প্রত্যক্ষদর্শী এক স্কুল শিক্ষক জানান, সকাল ৮টার দিকে মিজমিজি আল আমিন নগর এলাকায় আইডিয়াল ইসলামিক কিন্ডারগার্টেনের প্লে গ্রুপের এক ছাত্রীকে ধরে নিয়ে যাচ্ছিল এক যুবক (২৫)।
এ সময় তিনি স্কুলের সামনে একটি ফার্মেসিতে বসেছিলেন। তাকে দেখে ওই ছাত্রী ‘স্যার স্যার’ বলে চিৎকার করে। তখন ওই যুবক ছাত্রীটিকে নিজের মেয়ে বলে পরিচয় দেয়। কিন্তু ছাত্রীটি বাবা নয় বলার সঙ্গে সঙ্গে ওই যুবককে রিকশা নিয়ে পালানোর চেষ্টা করে।
এ সময় আশপাশের লোকজন এসে তাকে আটক করে গণপিটুনি দেয়। খবর পেয়ে পুলিশ তাকে উদ্ধার করে নারায়ণগঞ্জ হাসপাতালে নিয়ে যায়। চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। পুলিশ জানায়, ওই যুবকের নাম পাওয়া যায়নি।
সকাল সাড়ে ১০টার দিকে পাইনাদীর নতুন মহল্লা এলাকার ইতালি প্রবাসী ইসমাইলের বাড়িতে শারমিন যায়। কিন্তু তার কথাবার্তা অসংলগ্ন হওয়ায় স্থানীয়রা তাকে ছেলে ধরা সন্দেহে গণপিটুনি দেয়। এ সময় শারমিন পাশের বিল্লাল হোসেনের বাড়িতে আশ্রয় নেয়।
খবর পেয়ে পুলিশ তাকে উদ্ধার করতে গেলে তাদের সঙ্গে এলাকাবাসীর ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটে। পরে পুলিশ লাঠিচার্জ করে তাকে উদ্ধার করে এবং খানপুর হাসপাতালে ভর্তি করে। শারমিন পটুয়াখালীর সদর উপজেলার মরিচবুনিয়া গ্রামের সালমান শাহর স্ত্রী।
সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ওসি শাহিন শাহ পারভেজ জানান, ছেলে ধরা সন্দেহ ওই নারীকে গণপিটুনি দিয়ে আটক করে রাখে। তাকে উদ্ধার করতে গেলে উত্তেজিত জনতা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। এ সময় পুলিশের একটি পিকআপ ভ্যানের কাচ ভাংচুর করা হয়।
তিনি আরও জানান, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে এক রাউন্ড ফাঁকা গুলিবর্ষণ করা হয়। ওই নারী মানসিক ভারসাম্যহীন বলেও জানান ওসি। তিনি আরও জানান, ছেলে ধরা সন্দেহে কাউকে গণপিটুনি না দিতে আমরা এলাকায় মাইকিং করার পাশাপাশি জনগণকে সচেতন করব।
কেরানীগঞ্জ (ঢাকা) : শুক্রবার রাত ৯টার দিকে কেরানীগঞ্জের হযরতপুর ইউনিয়নের রসুলপুর গ্রামে অজ্ঞাতপরিচয় দুই যুবককে গণপিটুনি দেয়া হয়। এতে একজন নিহত ও অন্যজন গুরুতর আহত হয়। অজ্ঞাত দুই যুবক গ্রামে ঘোরাঘুরি করলে স্থানীয়দের সন্দেহ হয়।
এক পর্যায়ে তাদের গণপিটুনি দেয়া হয়। খবর পেয়ে পুলিশ তাদের উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যায়। সেখানে একজনকে ভর্তি করা হলেও অন্যজনকে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। হাসপাতালে নেয়ার পর চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
কেরানীগঞ্জ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাকের মোহাম্মদ যোবায়ের জানান, আহত ও নিহত যুবকের পরিচয় জানা যায়নি। আহত যুবক সুস্থ হলে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
তিনি আরও জানান, এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে অজ্ঞাত কয়েকশ’ লোককে আসামি করে মামলা করা হয়েছে।
গাজীপুর : চান্দনা চৌরাস্তায় গণপিটুনির শিকার নারীকে শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। গণপিটুনির শিকার মমতাজ খাতুন (৪৫) মানসিক ভারসাম্যহীন।
মহানগরের বাসন থানার ওসি একেএম কাউসার জানান, শনিবার সকাল সাড়ে ৭টার দিকে চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় মমতাজকে সন্দেহজনকভাবে ঘোরাঘুরি করতে দেখে এলাকাবাসী।
এক পর্যায়ে রাস্তার পাশে এক শিশুকে আদর করতে গেলে তাকে আটক করা হয়। পরে স্থানীয়রা তাকে ছেলে ধরা সন্দেহে গণপিটুনি দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করে। নেত্রকোনার দুর্গাপুর এলাকার আবদুল আলীমের স্ত্রী মমতাজ।
চুয়াডাঙ্গা : আলমডাঙ্গা শহরে মানসিক ভারসাম্যহীন বৃদ্ধ মহির উদ্দিনকে ছেলে ধরা বলে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়েছে।
শুক্রবার সকালে শহরের বিদ্যুৎ অফিসের সামনে রামদার উল্টো পিঠ দিয়ে মহিরের সারা শরীর থেঁতলে দেয়া হয়। এরপর রাস্তার তার মাথা আছড়ে ক্ষতবিক্ষত করা হয়। মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে ফেলে সটকে পড়ে নির্যাতনকারীরা। মহিরের বাড়ি শহরের গোবিন্দপুর গ্রামে। পুলিশ বলেছে মহির মানসিক রোগী।
প্রত্যক্ষদর্শীরা নির্যাতনের কারণ জানতে চাইলে নির্যাতনকারীরা বলে ‘এ লোক ছেলে ধরা। তার ব্যাগে মানুষের মাথা পাওয়া গেছে।’ পুলিশ তাকে উদ্ধার করে প্রথমে স্থানীয় ফাতেমা ক্লিনিক ও পরে আলমডাঙ্গা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করে।
এ ব্যাপারে আলমডাঙ্গা থানার এসআই জিয়াউর রহমান বলেন, এ ঘটনার পর থেকে নির্যাতনকারী টুটুল গা ঢাকা দিয়েছে। তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটিও বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।
থানার ওসি মুন্সি আসাদুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, মহির মানসিক ভারসাম্যহীন। তাকে ছেলে ধরা বলে অপবাদ দিয়ে নির্যাতন করা অন্যায়। মহিরের ছেলে মোমিনকে মামলা করতে বলা হয়েছে। মামলা না হলেও টুটুলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
পুলিশ সদর দফতরের বার্তা : গুজবে কান না দেয়ার আহ্বান জানিয়েছে পুলিশ সদর দফতর।
শনিবার বিকালে এ আইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) মো. সোহেল রানা স্বাক্ষরিত এক বার্তায় এ আহ্বান জানিয়ে বলা হয়, দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করা রাষ্ট্রবিরোধী কাজের শামিল। গণপিটুনি দিয়ে মানুষ মারাকে বড় ধরনের অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করে তা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানানো হয়।
পুলিশ সদর দফতর জানায়, পদ্মা সেতু নির্মাণে মাথা লাগবে- একটি মহল এমন গুজব ছড়ানোর পর দেশের বিভিন্ন স্থানে কয়েকজন গণপিটুনিতে প্রাণ হারিয়েছেন। কিন্তু ছেলে ধরা সন্দেহে গণপিটুনি দেয়া ফৌজদারি অপরাধ। জনগণকে আইন নিজের হাতে তুলে না নেয়ার আহ্বান জানানো হয়। এতে বলা হয়, গণপিটুনির ঘটনা তদন্ত করে জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হবে।