চলনবিলের কৃষি-জীববৈচিত্র্য জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকিতে

: নুরুল করিম রাসেল
প্রকাশ: ৭ years ago

টেকনাফ টুডে ডেস্ক : জলবায়ু পরিবর্তন আর ফারাক্কার বিরূপ প্রভাবে হুমকিতে পড়েছে বাংলাদেশের বৃহত্তম বিল চলনবিলের কৃষি ও জীববৈচিত্র্য। এক সময় সারাবছর পানি থাকলেও দেশের একমাত্র প্রবাহমান বিলটিতে শুষ্ক মৌসুমে দেখা দিয়েছে সেচ সংকট। এতে কৃষকের উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির পাশাপাশি যথেচ্ছ রাসায়নিক ও কীটনাশকের ব্যবহারে অস্তিত্ব হারিয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির জলচর প্রাণী ও পাখি। পরিবেশবিদরা বলছেন, প্রকৃতির উপর অযাচিত হস্তক্ষেপ বন্ধে এখনই উদ্যোগ না নিলে এ অঞ্চলে ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা দিতে পারে।
বর্ষার পানি নামার পর চলনবিলের বুকজুড়ে আবাদ হয় বোরো ধান, সরিষা, রসুন, গম প্রভৃতি ফসলের। অপার জলসমূদ্র, চলনবিল পরিণত হয় সবুজের গালিচায়। দিগন্ত বিস্তৃত এই সবুজ ফসলের মাঠ দেখে চোখ জুড়ালেও গত কয়েক বছর ধরে প্রশান্তি নেই কৃষকের মনে। কারণ, অভাবনীয় বাস্তবতায় ক্রমশ পানিশূন্য হয়ে পড়ছে চলনবিল। এক সময় যে বিলের পানিতেই সারা বছর চলেছে সেচের কাজ, সেখানেই শুষ্ক মৌসুমে এখন পানির জন্য হাহাকার। ভূগর্ভস্থ পানির উপর অতিরিক্ত নির্ভরতায় পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। এতে চাষাবাদে খরচ বাড়ার পাশাপাশি, বিরূপ প্রভাব পড়েছে পরিবেশেও।
সম্প্রতি চলনবিল অধ্যুষিত পাবনা, সিরাজগঞ্জ ও নাটোরের বিভিন্ন উপজেলা ঘুরে দেখা মিলেছে ভয়ানক এই চিত্রের। পানির স্তর অনেক নিচে নেমে যাওয়ায় এ অঞ্চলের কৃষকরা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন।
পাবনার চাটমোহর উপজেলার হান্ডিয়াল ইউনিয়নের কৃষক আবু তালেব জানান, এ বছর ফাল্গুনের প্রথমেই পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় সেচের কাজ ব্যাহত হচ্ছে। ডিজেল চালিত শ্যালোমেশিনে ঠিকমত পানি উঠছে না। ইতোমধ্যে বেশ কিছু অগভীর নলকূপ নষ্ট হয়ে পড়েছে। শ্যালো পাম্পগুলোতে পানি কম উঠায় তা গভীর থেকে আরো গভীরে নামানো হচ্ছে। মাটি থেকে ১০ থেকে ১২ ফুট গভীরে গর্ত করে শ্যালোমেশিন ও পাম্প বসানো হচ্ছে। বিদ্যুতের যে দাম তাতে উৎপাদন ব্যয় যেভাবে বাড়ছে, সে অনুপাতে ধানের দাম পাওয়া খুবই মুশকিল।
চলনবিলের সিরাজগঞ্জ অংশের উল্লাপাড়া উপজেলার প্রতাপ, গজাইল, তেলিপাড়া, তেবাড়িয়া, শ্যামপুর, বাঘমারা, পাঙ্গাসীলাহিড়ী, মোহনপুর, তাড়াশ উপজেলার চকরসুল্লাহ, কালিদাসনিলী, গোয়ালগ্রাম, মহিষলুটি, বাশবাড়িয়া, কালুপাড়া, খালকুলা, মাটিয়ামালিপাড়া গোবরপাড়া, ভাটরা, হাসানপুর, নবীপুর, সাকোইদীঘি, রমমহল, নওগাঁ, বিরৌহালি, কোনাবাড়ী, দেবীপুর, নলুয়াকান্দি, দোবিলা, হামকুড়িয়া, নাদোসৈয়দপুর, ধামাইচ, পাবনা অংশের ভাঙ্গুড়া উপজেলার খানমরিচ, বিদ্ধমরিচ, সমাজ, চন্ডিপুর, মেসমোথুর, বাঘলবাড়ী চাটমোহরের চন্ডিপুর, হরিপুর, কাটেঙ্গা, সমাজ, ছাইকোলা, বোয়ালমাটি, হালদারপাড়া, বোথরসহ বিভিন্ন গ্রাম সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় ১২-১৫ ফুট মাটির নিচে গর্ত করে ডিজেলচালিত ও বিদ্যুৎ চালিত মেশিন বসানো হয়েছে। প্রতি বছর পানির স্তর আরো নিচে নামছে। ফলে বিপাকে পড়ছেন বিল নির্ভর কৃষিজীবী মানুষ।
স্থানীয়রা জানান, আশির দশক থেকে চলনবিলে পানির স্তর নিচে নামতে শুরু করে। ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রভাবে পানি উন্নয়ন বোর্ড ও স্থানীয় সরকার বিভাগের অপরিকল্পিত ক্রসবাঁধ, রাবার ড্যামের কারণে এসব প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। এর পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তন এবং অনাবৃষ্টির কারণে ক্রমাগত ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনে পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে।
চলনবিল অঞ্চলের চাটমোহরের হান্ডিয়াল গ্রামের প্রবীণ কৃষক মোতালেব হোসেন জানান, চলনবিলে বোরো আবাদে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় দিন দিন বোরো আবাদ হুমকির মুখে পড়ছে। চলতি বছর পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় চলনবিলের প্রায় ২ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ সংকটের আশঙ্কা করা হচ্ছে।
জেলা কৃষি বিভাগ জানায়, বিগত কয়েক বছর ধরে চলনবিলাঞ্চলে গভীর ও অগভীর নলকূপে পানি না ওঠায় বহু কৃষক সংকটে পড়ছেন। ইরি বোরো আবাদে যে পরিমাণ পানির প্রয়োজন সে পরিমাণ পানি এ অঞ্চলের খালবিল ও নদী নালায় রিজার্ভ থাকছে না। এ কারণে ভূগর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত উত্তোলনে পানির স্তর ক্রমশ নিচে নেমে যাচ্ছে। বিশেষ করে কৃষি কাজে ব্যবহৃত হাজার হাজার গভীর ও অগভীর নলকূপ স্থাপনের মাধ্যমে সেচ কাজ করে সাময়িক কৃষি কাজে সুবিধা বাড়ালেও তার বিরূপ প্রভাবে পানির স্তর আরও নিচে নেমে যায়। চলনবিলাঞ্চালে কৃষি কাজে ব্যবহৃত ভূগর্ভস্থ পানির পরিমাণ প্রায় ৯৮ ভাগ। এভাবে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় সেচ কাজে মারাত্মক বিপর্যয় ঘটার আশঙ্কা রয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর পাবনার উপ-পরিচালক বিভূতিভূষণ সরকার জানান, সেচ সংকট ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কৃষক ধান আবাদে নিরুৎসাহিত হচ্ছে। তারা বিনা চাষে রসুন, বিভিন্ন ধরণের ডাল, ভুট্টা ইত্যাদি ফসলের আবাদ করছে।
এদিকে, জলবায়ু পরিবর্তন ও চাষাবাদে বেশি পরিমাণে কীটনাশকের ব্যবহারের প্রতিক্রিয়ায় বিলুপ্ত হয়েছে চলনবিলের ৭২ প্রজাতির মাছ, ৭১ প্রজাতির পাখি, ২৮ প্রজাতির প্রাণী, ১৭ প্রজাতির সরীসৃপ আর নানা ধরনের জলজ সম্পদ। হারানোর তালিকায় রয়েছে ৪১ জাতের আউশ ধান ও ১০ জাতের আমন ধান।
চলনবিলের জীববৈচিত্র্য নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করছেন কৃষিবিদ আব্দুল মান্নান পলাশ।
তিনি জানান, ৩০ বছর আগেও এই চলনবিল ছিল এক ছোটখাটো সমুদ্র। তখন সারা বছর বিলে পানি থাকতো। পাওয়া যেতো দেশি জাতের মিঠাপানির সুস্বাদু মাছ। আর দেশি জাতের আমন-আউশ ধানই ছিল চলনবিলের প্রধান ফসল। সুখ্যাত পানসা ফল, পদ্মচাকা, মাখনা, শিঙ্গট, ঢ্যাপ, শালুক-শাপলা জাতীয় স্বাদু ফল পাওয়া যেতো বিলের পানিতে। বিভিন্ন প্রজাতির সাপ, কচ্ছপ, ঝিনুক ও জোঁক ছিল বিলে বেশুমার। বিলের বদ্ধ জলাশয়ের আমন-আউশ ধানের সঙ্গে এসব জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণীর ছিল অবাধ বিচরণ। এগুলো খেয়েই বেঁচে থাকতো বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ও পাখি। সেসবের কিছুই এখন আর চোখে পড়ে না।
চলনবিল উদ্ধার আন্দোলন কমিটির সদস্য সচিব এসএম মিজানুর রহমান বলেন, দীর্ঘদিন যাবত নদীগুলো খনন না হওয়ায় নাব্যতা হারিয়ে ফেলেছে। ফলে বছরের প্রায় ৭ মাস পানিশুন্য থাকছে। চাটমোহরেরসহ চলনবিলের নদীগুলোর পাড়ের হাজার হাজার কৃষক নদী থেকে পানি উত্তোলন করে জমিতে সেচ দিতে পারছে না। তারা নদীগুলো খনন করে পানি ধারণের উপযোগী করার দাবী জানিয়ে আসছে দীর্ঘদিন।
পরিবেশের উপর অযাচিত হস্তক্ষেপ বন্ধ না হলে এ অঞ্চলে ভয়াবহ বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন পরিবেশবিদরা।
এ প্রসঙ্গে পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. নাজমুল ইসলাম বলেন, পরিবেশগত সমীক্ষা ছাড়া বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতিকর প্রভাব ডেকে এনেছে চলনবিলের প্রাণ প্রকৃতি ও বিলনির্ভর মানুষের জীবন জীবিকায়। প্রকৃতি যদি তার উপর অত্যাচারের প্রতিশোধ নেয়, তা কতটা ভয়াবহ হতে পারে তা হাওর অঞ্চলের মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে। চলনবিল অঞ্চলে বিগত কয়েক দশকে তাপমাত্রা বেড়েছে বহুগণ, খরা, অসময়ে বন্যার মত প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিচ্ছে। চলনবিলের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় পরিবেশগত সমীক্ষা সাপেক্ষে পরিকল্পিত উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা গেছে, ১৯৭০ সালে চলনবিলের উন্নয়নের লক্ষে ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘চলনবিল প্রকল্প’ হাতে নেয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী ২৫১ মাইল বাঁধ, ১৮৭টি খাল, ২৪টি রেগুলেটর, ৫৮টি ফ্লাসিংইনসেট, ৫৫টি ব্রিজ এবং ১৩২টি কালভার্ট নির্মাণের কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়। কিন্তু ১৯৮৪ সালে রাজশাহীর চারঘাটে পদ্মায় বড়াল নদীর উৎসমুখে একটি রেগুলেটর নির্মাণ করার পর প্রকল্পটি বন্ধ হয়ে যায়।
কৃষি বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে কেবল চলনবিল এলাকার ফসলাদিই বন্যার কবল থেকে রক্ষা পেতো না, অনাবাদী ও জলাবদ্ধ জমিতে ফসল চাষ করে এবং সুষ্ঠু সেচ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ১০০ কোটি টাকার অতিরিক্ত ফসল উৎপাদন সম্ভব হতো। আর পরিকল্পিতভাবে মাছচাষ ও অভয়ারণ্য করা সম্ভব হত।