এম জিয়াবুল হক : শনিবার সারাদিন গুড়ি গুড়ি বৃষ্টিপাত হচ্ছে কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার বিভিন্ন এলাকায়। এরই মধ্যে আবহাওয়া জানান দিচ্ছে ধেয়ে আসছে ঘুর্ণিঝড় মোখা। অবশ্য ঘুর্ণিঝড়ের সমুহ তান্ডব মোকাবিলায় উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে আগে থেকে ব্যাপক প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে উপকূলীয় অঞ্চলসহ উপজেলার ১৮টি ইউনিয়নে প্রস্তুত রাখা হয়েছে স্কুল কাম ৯৮ টি সাইক্লোন সেন্টার।
শুক্রবার বিকাল থেকে এসব সাইক্লোন সেন্টারে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করছেন রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির (সিপিপি) ইউনিয়ন পর্যায়ের সদস্য ও আনসার ভিডিপির সদস্যরা। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন চকরিয়া উপজেলা রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির টিম লিডার ও পশ্চিম বড়ভেওলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আলহাজ্ব সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বাবলা।
তিনি বলেন, দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় শুক্রবার বিকাল থেকে রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির (সিপিপি) সদস্যরা মাইকিং করে জনগণকে সচেতনতা করতে কাজ শুরু করেছেন। জনসাধারণকে বাড়ির মালামাল গবাদি পশু নিয়ে নিকটস্থ আশ্রয়কেন্দ্রে চলে আসার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে। সরকারি ভাবে আশ্রয়কেন্দ্র গুলোতে অবস্থান নেওয়া মানুষের জন্য শুকনো খাবার ও সুপেয় পানির ব্যবস্থা নিয়েছেন।
জানা গেছে, ধেয়ে আসা ঘূর্ণিঝড় “মোখা” নিয়ে আবহাওয়া অধিদপ্তর কক্সবাজারের উপকূলীয় জনপদে ১০নং মহাবিপদ সংকেত ঘোষণা দিলেও শুক্রবার বিকাল থেকে শনিবার সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত বেশিরভাগ আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেনি দুর্যোগপ্রবণ এলাকার বাসিন্দারা। এমনকি ঘুর্ণিঝড়ের প্রভাবের মধ্যে জনগণের মাঝে নেই কোন আতঙ্ক বা ভয়। উল্টো চলছে তাদের স্বাভাবিক জীবন যাত্রা।
১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে সচেতনতার অভাবে ব্যাপক মানুষের মৃত্যু হলেও এবারকার ঘূর্ণিঝড় মোখা নিয়ে তেমন মাথা ব্যাথা নেই চকরিয়া উপজেলার উপকূলীয় অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায়।
শনিবার বিকাল দুইটার দিকে চকরিয়া উপজেলার চিরিঙ্গা ইউনিয়নের চরণদ্বীপের দুটো আশ্রয়ণ কেন্দ্র সরেজমিন পরিদর্শনকালে দেখা যায়, চরণদ্বীপ ভূমিহীন সমবায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কাম আশ্রয় কেন্দ্রে স্থানীয় কিছু এলাকাবাসী ধানভর্তি শতাধিক বস্তা নিয়ে সেখানে অবস্থান করছেন। বৃষ্টিতে ভিজার আশঙ্কায় ধানগুলো কেন্দ্রে রাখছেন। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় মোকা নিয়ে তেমন আলোচনা নেই তাদের মধ্যে। যখনই ঘূর্ণিঝড় মোখা আঘাত হানবে তখনই আশ্রয়ণ কেন্দ্রে উঠবেন বলে জানিয়েছেন এলাকাবাসী।
তবে শুক্রবার রাতে ২০-২৫ জন নারী পুরুষ আশ্রয়ণ কেন্দ্রে উঠলেও পরদিন সকালে বাড়িতে চলে গেছে। ঘূর্ণিঝড় মোখা নিয়ে তাদের ভয় বা কোন শঙ্কা নেই। ওই আশ্রয়ণ কেন্দ্রে দেড় শতাধিক মানুষ অবস্থান করতে পারবে। যখন আসবেন তখনই খুলে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক।
তিনি আরও বলেন, প্রচার প্রচারণা থাকলেও মানুষের মাঝে সচেতনতার অভাবে আসছে না আশ্রয়ণ কেন্দ্র গুলোতে।
একই অবস্থা দেখা গেছে, চকরিয়া উপজেলার বদরখালী ও পশ্চিম বড়ভেওলা ইউনিয়নের কয়েকটি আশ্রয় কেন্দ্র ঘুরে। বেশিরভাগ আশ্রয় কেন্দ্র শনিবার সন্ধ্যা ছয়টা নাগাদ প্রায় ফাঁকা অবস্থায় আছে। বদরখালী সমিতির ভবনে আশ্রয় নিয়েছেন বেশকটি পরিবার। তবে পরিবারের নারী শিশু সদস্যরা আশ্রয় কেন্দ্রে আসলেও পুরুষ সদস্যদের উপস্থিতি তুলনামূলক কম। আশ্রয় নেওয়া পরিবারের নারী সদস্যদের দাবি, বসতবাড়ির মালামাল ও গবাদি পশু দেখভাল করতে মুলত পুরুষ সদস্যরা বাড়িতে রয়েছেন।
এদিকে ঘুর্ণিঝড় মোখা ঘিরে বেশিরভাগ আশ্রয় কেন্দ্রে চকরিয়া উপজেলা প্রশাসনের পক্ষথেকে সবধরণের সুযোগ সবিধা রাখা হয়েছে। আশ্রয় কেন্দ্র গুলোতে গর্ভবতী নারীদের জন্য আলাদা কক্ষ রয়েছে। আশ্রয় কেন্দ্র গুলো ইতোমধ্যে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করে প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
চিরিঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জামাল হোছাইন চৌধুরী বলেন, চিরিঙ্গা ইউনিয়নের আশ্রয় কেন্দ্র গুলোতে বিপুল পরিমাণ মানুষ অবস্থান করতে পারবেন। সেইজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। চরনদ্বীপ ভুমিহীন সমিতির পাশের ওয়ার্ডে অপর আশ্রয়ণ কেন্দ্র চরণদ্বীপ ডূলখালী সরকারি বিদ্যালয় ও বহুমুখী দূর্যোগ আশ্রয়ণ কেন্দ্রে দেড় হাজার নারীপুরুষ থাকার ধারণা ক্ষমতা রয়েছে।
স্থানীয় লোকজন জানান, শুক্রবার রাতে চিরিঙ্গা ইউনিয়নের আশ্রয় কেন্দ্রে অর্ধশতাধিক নারীপুরুষ রাত যাপন করেন ওইকেন্দ্রে। নিচতলায় শতাধিক গরু ছাগল রাখা হলেও পরদিন সকালে বাড়ি নিয়ে যান। তাদের বক্তব্য, ঘূর্ণিঝড় মোখার কোন ধরণের আঘাত না করায় আমরা বাড়ি চলে গেছি। যদি বাতাসের তিব্রতা বেড়ে গেলে পূনরায় কেন্দ্রে চলে আসবো বলে জানান।
এদিকে ঘুর্ণিঝড় নিয়ে সচেতনতামূলক প্রচার প্রচারণা এগিয়ে রয়েছেন চকরিয়া পৌরসভা। পৌরসভার পক্ষ থেকে ৯টি ওয়ার্ডের বিভিন্ন এলাকায় মাইকিং করা হচ্ছে। ঘূর্ণিঝড় মোকার ক্ষতি এড়াতে সবধরণের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।
চকরিয়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আলহাজ্ব ফজলুল করিম সাঈদী বলেন, ঘূর্ণিঝড় মোখার ক্ষতি এড়াতে উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে সবধরণের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। উপজেলার ১৮টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভায় আশ্রয়ণ কেন্দ্র গুলো খোলা রাখা হয়েছে। সার্বক্ষনিক মনিটরিংয়ে জন্য একটি নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খোলা রাখা হয়েছে। পাশাপাশি দুর্গত মানুষের জন্য শুখনো খাবার, বিস্কুট ও পানিবিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট রাখা হয়েছে। মোখা আঘাত হানলে ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের পাশে থাকা হবে।
চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) সহকারী কমিশনার ভুমি মো রাহাত উজ জামান বলেন, ধেয়ে আসা সম্ভাব্য ঘুর্ণিঝড় মোখার তান্ডব মোকাবিলায় চকরিয়া উপজেলা প্রশাসন সার্বিক প্রস্তুতি গ্রহণ করেছেন। ইতোমধ্যে উপজেলার দুর্যোগ প্রবণ এলাকায় প্রস্তুত রাখা হয়েছে ৯৮টি সাইক্লোন সেন্টারকে। পাশাপাশি উপজেলার ১৮টি ইউনিয়নের জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে একটি করে মোট ১৮টি ভ্রাম্যমান মেডিকেল টিম।
ভারপ্রাপ্ত ইউএনও মো.রাহাত উজ জামান বলেন, ঘুণিঝড়ের আগেরদিন শুক্রবার থেকে রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির সিপিপি ও আনসার সদস্যরা দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় সাইক্লোন সেন্টারে নিরাপত্তা ও লোকজনের থাকা খাওয়া সব বিষয়ে তদারকি করবেন। দুর্গত জনপদে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মোট ৭০টি বিভক্ত হয়ে কাজ করবে।
দুর্যোগ মোকাবেলার অংশ হিসেবে জনগণের মাঝে চিকিৎসা সেবা নিশ্চিতে চকরিয়া উপজেলা সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক নার্স সমন্বয়ে মোট ১৮টি মেডিকেল টিম উপজেলার ১৮ ইউনিয়নে দায়িত্ব পালন করবেন। এছাড়া উপজেলা প্রাণী সম্পদ বিভাগ থেকে দুর্যোগমুহুর্তে গবাদি পশুর চিকিৎসার জন্য ভেটেরিনারি মেডিকেল টিমও কাজ করবে। তারা বলেন, দুর্গত জনপদের সার্বিক নিরাপত্তা ও জনগণের বিপদ সংকুলান মুহূর্তে চকরিয়া থানা পুলিশের একাধিক টিম মাঠ থাকবেন। পাশাপাশি সরকারি হাসপাতালের দুইটি এম্বুলেন্স ও থানা পুলিশের দুই গাড়ি জরুরি মুহূর্তে পরিবহন কাজে নিয়োজিত রয়েছেন। ##