কিশোরেরা বিপথগামী

: হুমায়ুন রশিদ
প্রকাশ: ৩ years ago

টেকনাফ টুডে ডেস্ক : দেশের সব জায়গায় পাড়া-মহল্লায় দাপিয়ে বেড়ায় কিশোর গ্যাং। আধিপত্য বিস্তার, সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্ব, প্রেম ও মাদক কারবার নিয়ে তাদের বিরোধ মাঝেমধ্যেই খুনোখুনিতে রূপ নেয়। শিশু আইন অনুযায়ী, বয়সের কারণে এসব কিশোর অপরাধীদের বেশিরভাগই গ্রেপ্তারের পর শিশু আদালতে বিচার হয়। কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাত ও অপরাধ বেড়ে যাওয়ায় এ ব্যাপারে সরকারের কঠোর অবস্থান ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলোর অভিযান চলছে নিয়মিত। এরপরও কেন তাদের দমানো যাচ্ছে না, এসব কিশোর গ্যাং সৃষ্টির পেছনে দায় কার এমন প্রশ্ন উঠেছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন অপরাধে সারা দেশ থেকে কিশোর গ্যাংয়ের ৬০৮ জন সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে শুধু ২০২১ সালেই গ্রেপ্তার হয়েছে ২৯০ জন। কিশোর গ্যাংয়ের সর্বশেষ শিকার ঢাকার আশুলিয়ার হাজী ইউনুছ আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক উৎপল কুমার সরকার। ক্রিকেট খেলার স্টাম্প দিয়ে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় ফের আলোচনায় এসেছে কিশোর গ্যাংয়ের বেপরোয়া কর্মকা-ের বিষয়টি। অপরাধ বিশ্লেষক ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলোর তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, কিশোরদের অপরাধ থেকে বিরত রাখতে সমাজের সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। পরিবার, সমাজ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে এসব কিশোরকে নৈতিক শিক্ষা দিতে হবে। গড়ে তুলতে হবে পর্যাপ্ত কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র। যাতে আইনের সঙ্গে সংঘাতে আসা শিশু-কিশোরদের অপরাধ মানসিকতা দূর করা যায়। এছাড়া কিশোর অপরাধ দমানো সম্ভব নয়। প্রথমত পরিবার থেকে, পরে সমাজ ও স্কুল থেকে কিশোরদের নৈতিক শিক্ষা দিতে হবে। এছাড়া কিশোর অপরাধ দূর করা সম্ভব নয়। কিশোরদের খারাপ পথে যাওয়ার দায় তাদের পরিবারেরও রয়েছে। এছাড়া কিশোর অপরাধীদের জন্য পর্যাপ্ত সংশোধনাগার প্রতিষ্ঠা করে সেখানে কাউন্সেলিংয়ের সুযোগ করে দিতে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে।

দেশজুড়ে নগরকেন্দ্রিক গ্যাং কালচার ভয়ংকর আকার ধারণ করেছে। মাদক নেশায় জড়িয়ে পড়া থেকে শুরু করে চুরি, ছিনতাই, ইভটিজিং, মাদক ব্যবসা, এমনকি নিজেদের অভ্যন্তরীণ বা অন্য গ্যাং গ্রুপের সঙ্গে তুচ্ছ বিরোধকে কেন্দ্র করে খুনখারাবি থেকেও পিছপা হচ্ছে না কিশোর অপরাধীরা। আরও উদ্বেগের বিষয়, মাদক নেশার টাকা জোগাড়ে ছোটখাটো অপরাধে জড়ানো বিভিন্ন গ্যাংয়ের সদস্যরা বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হয়ে উঠছে ভয়ংকর অপরাধী, এলাকার ত্রাস। এর পেছনের অন্যতম কারণ রাজনৈতিক ‘বড় ভাই’দের স্বার্থের প্রশ্রয়। একসময় ঢাকা-চট্টগ্রামসহ বড় শহরকেন্দ্রিক থাকলেও বর্তমানে গ্যাং কালচার সমস্যা ছড়িয়ে পড়েছে ছিমছাম, নীরব জেলা-উপজেলা শহরগুলোতেও।

অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্যাং কালচারে অভ্যস্ত হয়ে ওঠা কিশোররা সমাজের কারও না কারও মদদপুষ্ট। তাদের আইনের আওতায় আনার পাশাপাশি পুনর্বাসনেও জোর দেওয়ার কথা বলেছেন তারা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মতে, সামাজিক সচেতনতা ও প্রতিরোধের পাশাপাশি কিশোরদের নিয়ন্ত্রণ বা সংশোধনের জন্য পরিবারের অভিভাবকদের সচেতন ও সক্রিয় হওয়া জরুরি। এছাড়া যারা এসব কিশোরকে অপরাধে সম্পৃক্ত করার নেপথ্যে রয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধেও আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে। শিশু-কিশোরদের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করা পরিহার করতে হবে। পাশাপাশি, সমাজ ও রাষ্ট্রকে যতই দায়িত্ব দেওয়া হোক না কেন, মনে রাখতে হবে সমাজের ক্ষুদ্রতম একক পরিবার। তাই পারিবারিক কাঠামো আরও সুসংহত করা ছাড়া কিশোর অপরাধ কমানো যাবে না। পরিবারে নৈতিকতার চর্চা বাড়াতে হবে। শিশুর সঙ্গে বা সামনে নিষ্ঠুর আচরণ থেকে বিরত থাকতে হবে। স্ক্রিনে নৃশংস দৃশ্য শিশুকে দেখানো যাবে না। বড় সময় স্কুলে কাটায় বলে শিশু-কিশোরদের ওপর শিক্ষকের আচরণ গভীর প্রভাব ফেলে। সেখানেও নিষ্ঠুরতা, বিদ্রƒপ বা তুলনা পরিহার করতে হবে। আমরা মনে করি, প্রত্যেক শিশু-কিশোরের সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনের নিশ্চয়তা দিতে হবে। কারও উপযুক্ত অভিভাবক না থাকলে রাষ্ট্রকে তার অভিভাবকের দায়িত্ব নিতে হবে। সব গণতান্ত্রিক ও কল্যাণমূলক রাষ্ট্র তা করে থাকে। উন্নয়নের মহাসড়কে ওঠা বাংলাদেশ কেন সেই দায়িত্বটুকু পালন করবে না? শিশু-কিশোরদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা তৈরি করা কোনো অপরাধ নয়, তবে তাদের দলীয় রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করা অবশ্যই নিন্দনীয়।

রাষ্ট্রকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে, প্রত্যেক শিশুর সুন্দর শৈশব এবং সুন্দর কৈশোরই তাকে অপরাধ থেকে মুক্ত করতে পারে। রাষ্ট্রকে এটা নিশ্চিত করতে হবে।