টেকনাফ টুডে ডেস্ক : চলমান মহামারীর এক বছর পেরিয়ে দেশে এখন করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউয়ের মারাত্মক প্রকোপ চলছে। করোনায় মৃত্যু ও সংক্রমণ শনাক্তের লাগাতার ঊর্ধ্বগতি শনিবারও অব্যাহত ছিল। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যানুসারে শুক্রবার সকাল থেকে শনিবার সকাল পর্যন্ত সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় করোনায় সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে ৫ হাজার ৬৮৩ জনের। শেষ এই ২৪ ঘণ্টায় করোনায় সংক্রমিত হয়ে মারা গেছেন ৫৮ জন। স্মরণ করা যেতে পারে, দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ চূড়ায় উঠেছিল গত বছরের জুন-জুলাই মাসে। ওই সময়ে, বিশেষ করে জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে জুলাই মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত প্রতিদিন গড়ে তিন থেকে চার হাজার রোগী শনাক্ত হতো। এখন আবার গত এক মাসের বেশি সময় ধরে সংক্রমণ ও মৃত্যু দুটোই ঊর্ধ্বমুখী। বিপজ্জনক এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রথমে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে ১৮ দফা নির্দেশনা জারি করা হয়। এর পরপরই এলো সোমবার থেকে সারা দেশে এক সপ্তাহের জন্য লকডাউনের ঘোষণা।
বিগত বছরের লকডাউনের সময় দেশের বিপুলসংখ্যক শ্রমজীবী-দিনমজুর কর্মহীন হয়ে পড়েছিলেন। নিম্ন আয়ের সাধারণ মানুষ লকডাউনের সময়টায় আয়রোজগার না থাকায় অসহনীয় পরিস্থিতিতে দিনাতিপাত করেছেন। সে সময়ে দেশে উল্লেখযোগ্য হারে দারিদ্র্য ও বেকারত্ব বেড়েছে। সম্ভবত এসব আশঙ্কার কারণেই লকডাউনের ঘোষণা অনেক মানুষকে আতঙ্কিত করে তুলেছে। কিন্তু ইতিমধ্যেই দেশের প্রায় অর্ধেক জেলায় সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার উচ্চ হার চিহ্নিত হয়েছে এবং অন্যান্য স্থানেও সংক্রমণ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। এমতাবস্থায় সংক্রমণ রোধে কঠোর লকডাউন দেওয়া ছাড়া হয়তো অন্য কোনো বিকল্পও নেই। কিন্তু মনে রাখা জরুরি যে, সর্বাত্মক লকডাউন একটা চূড়ান্ত কর্মসূচি। জনসমাগম নিয়ন্ত্রণ, সমাজে শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে চলাচল, মাস্ক পরিধান ও হাত ধোয়াসহ নিয়মিত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ওপর জোর দিয়েও পরিস্থিতি সামাল দেওয়া না গেলে তখনই কেবল লকডাউন দেওয়ার কথা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও বাস্তবতা এটাই যে, কি সরকার কি জনগণ উভয় পক্ষই এ বিষয়ে এতদিন গা ছাড়া ভাব দেখিয়েছে।
সোমবার থেকে এক সপ্তাহের জন্য লকডাউনের ঘোষণার সমালোচনা করেছেন জনস্বাস্থ্যবিদ ও মহামারী বিশারদরা। তারা বলছেন, বৈজ্ঞানিক বিবেচনা থেকে লকডাউন দিলে সেটা কমপক্ষে দুই সপ্তাহ হওয়া উচিত, এক সপ্তাহের লকডাউন স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনাভাইরাসের সুপ্তিকাল ১৪ দিন। অর্থাৎ করোনাভাইরাস শরীরে ১৪ দিন পর্যন্ত ঘাপটি মেরে থাকতে সমর্থ। শরীরে প্রবেশের ১৪তম দিনেও ভাইরাসটি রোগ তৈরিতে সক্ষম। এজন্য বৈজ্ঞানিক বিবেচনা থেকে লকডাউন দিলে তা কমপক্ষে দুই সপ্তাহ হওয়া উচিত। অবশ্য জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী জানিয়েছেন, এই সাত দিনের লকডাউনের শেষ দিকে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে প্রয়োজনে লকডাউন আরও বাড়ানো হতে পারে। লকডাউনে কেবল জরুরি সেবা দেয় এমন প্রতিষ্ঠানগুলোই খোলা থাকবে। আর তৈরি পোশাক খাতসহ শিল্পকারখানাও খোলা থাকবে এবং শ্রমিকরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে পালা করে কাজ করবেন বলেও জানিয়েছেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী।
লকডাউন অর্থবহ করে তুলতে হলে সবার আগে স্বাস্থ্য খাতসহ অন্যান্য জরুরি সেবা নিশ্চিত করতে হবে। সরকারি অফিসের সঙ্গে বেসরকারি ও ব্যক্তিমালিকানাধীন ছোট-বড় প্রতিষ্ঠানগুলোতেও জনবল কমিয়ে আনা এবং পালা পদ্ধতি চালু করতে হবে। আর যেসব প্রতিষ্ঠানে অনলাইনে হোম-অফিস চালু করা সম্ভব সেখানে সেটা নিশ্চিত করতে হবে। একইসঙ্গে লোকজনকে স্বাস্থ্যবিধি মানতে বাধ্য করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে মাঠে নামিয়ে কঠোর বার্তা দিতে হবে। কিন্তু এক্ষেত্রে সবচেয়ে জরুরি প্রশ্ন হলোদিনমজুরসহ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিক এবং নি¤œ আয়ের মানুষদের জন্য সামাজিক সুরক্ষার বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করা। বিগত দিনের লকডাউনের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে এ বিষয়ে আগেই একটি সামাজিক সুরক্ষার পরিকল্পনা নেওয়া প্রয়োজন ছিল যে, লকডাউন দিতে হলে এই শ্রেণির মানুষের জীবিকা ও টিকে থাকার ব্যবস্থা কীভাবে সামলানো হবে। গত বছরের অভিজ্ঞতা বলছে, বড় শিল্পপতি ও পুঁজিপতি শ্রেণির উদ্যোক্তারা করোনা মোকাবিলার অর্থনৈতিক বিশেষ প্রণোদনার সুবিধা সময়মতো গ্রহণ করতে পারলেও ছোট উদ্যোক্তা ও শ্রমিকশ্রেণি এই সুবিধার ন্যায্য হিস্যা পাননি। কিন্তু লকডাউনের মতো কর্মসূচি সফল করতে এই শ্রেণির জীবিকার নিরাপত্তাই সবার আগে নিশ্চিত করতে হবে।
মহামারী মোকাবিলা করার অর্থ জীবন ও জীবিকা দুটোরই নিশ্চয়তা বিধান করা। কিন্তু মহামারীর এক বছর পেরুলেও স্বাস্থ্য খাতের যে তেমন কোনো উন্নতি করা হয়নি সেটা এখনো করোনা হাসপাতালের শয্যা ও আইসিইউর তীব্র সংকট থেকেই স্পষ্ট। মহামারী মোকাবিলায় স্বাস্থ্য খাতের জন্য বরাদ্দ করা হাজার কোটি টাকার বিশেষ বরাদ্দ কী কাজে লাগল এখন সেই হিসাব মেলানো জরুরি। স্বাস্থ্যসেবার এই নাজুক পরিস্থিতির বদল ঘটানো ছাড়া এমন প্রাণঘাতী মহামারী সামাল দেওয়া সম্ভব হবে না।