যুগান্তর |
১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর ভারতীয় সেনাবাহিনীর এক মেজর ঢাকায় পাকিস্তানি সেনাদের হাত থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারের সদস্যদের অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করে এনেছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধে অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ওই সেই সেনা কর্মকর্তা অশোক তারাকে পরে বাংলাদেশ সম্মাননা প্রদান করেছে। খবর বিবিসির।
বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ অন্যদের কীভাবে সেদিন তিনি প্রাণে বাঁচিয়েছিলেন, সেই কাহিনী অশোক তারা নিজেই সাংবাদিকদের বর্ণনা করেছেন।
তিনি বলেন, ‘একাত্তরের ১৫-১৬ ডিসেম্বরের রাতে আমরা পাকিস্তানি বাহিনীর কব্জা থেকে ঢাকা বিমানবন্দর দখল করলাম। পর দিন বিকালেই জেনারেল নিয়াজি সই করলেন আত্মসমর্পণের সেই ঐতিহাসিক দলিলে।
বিকালের দিকে আমরা বিমানবন্দরের রানওয়েতে বসেই একটু রিল্যাক্স করছিলাম। নিজেদের মধ্যে নানা গল্প চলছিল।
সেই সময় ওয়্যারলেসে মেসেজ এলো, এয়ারপোর্টের নিরাপত্তা আরও জোরদার করতে হবে। কারণ আগামী কয়েক দিনে সেখানে ভিভিআইপিদের আনাগোনা অনেক বাড়বে।
তো পর দিন খুব সকাল থেকেই আমি ও আমার সহকর্মী মেজর খান্না মিলে লেগে পড়ি এয়ারপোর্টের নানা দিকে সেনা মোতায়েনের কাজে।
১৭ই ডিসেম্বর সকাল ৮টা দিকে মুক্তি বাহিনীর এক কিশোর যোদ্ধা ছুটতে ছুটতে আমাদের দিকে এগিয়ে এলো।
তার পর বাংলা আর ভাঙা ভাঙা হিন্দি মিশিয়ে, হাফাতে হাফাতে ওই ছেলেটি যা বলল, তার মর্মার্থ হলো– পাকিস্তানি সেনারা এখনও কিন্তু ধানমণ্ডিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারকে আটকে রেখেছে।
আর সে আরও শুনেছে, তারা নাকি যে কোনো সময় গোটা পরিবারকে গুম করে দিতে পারে।
আমার সিও (কমান্ডিং অফিসার) আমাকে বললেন, তুমি ওর সঙ্গে এক্ষুণি ধানমণ্ডি যাও। গিয়ে দেখো তো ব্যাপারটি কী!
আমি তো সঙ্গে সঙ্গে মাত্র দুজন জওয়ান আর ওই মুক্তিযোদ্ধাকে সঙ্গে নিয়ে ধানমণ্ডির দিকে রওনা দিলাম। আমাদের বাহন ছিল শুধু একটা এক টনের মিলিটারি গাড়ি।
প্রসঙ্গত শেখ মুজিবের পরিবারকে কিন্তু ধানমণ্ডির বিখ্যাত বত্রিশ নম্বরে নয়, যুদ্ধের সময় গৃহবন্দি রাখা হয়েছিল ওই এলাকারই অন্য একটি বাড়িতে।
ধানমণ্ডির ওই বাড়িটি থেকে যখন আমরা মাত্র একশ গজ দূরে, তখন এক বিশাল জনতা ঘিরে ধরে আমাদের রাস্তা আটকাল। তারা বলতে লাগল, আর একদম এগোবেন না।
কী ব্যাপার? ওই জনতা তখন জানাল বঙ্গবন্ধুর বাড়ির পাহারায় থাকা পাকিস্তানিরা মারাত্মক খুনে মেজাজের, যারাই ওই বাড়ির দিকে এগোচ্ছে তাদের দিকে তারা গুলি চালাচ্ছে!
একটু দূরেই পড়েছিল একটা বুলেটবিদ্ধ গাড়ি আর ভেতরে এক সাংবাদিকের টাটকা লাশ। এলাকার লোকজন দূর থেকে আমাদের সেটি দেখিয়ে বলল– কয়েক মিনিট আগেই ওই বাড়িটির দিকে যেতে গিয়ে তার এই পরিণতি হয়েছে।
এমনকি সকালের দিকে পাকিস্তানিরা আরও একটা স্থানীয় পরিবারের দিকেও গুলি চালিয়েছে, জখম হয়েছেন তারাও।
সব শুনেটুনে আমি একটু থমকে গেলাম। তার পর দু-তিন মিনিট ভাবলাম আমার এখন কী করা উচিত।
প্রথমেই মনে হলো, আমি যদি এখন বাড়তি সেনা চেয়ে পাঠাই আমার সিনিয়ররা হাজারটা প্রশ্ন করবেন। তাদের সব বুঝিয়ে সুঝিয়ে যদি বাড়তি সেনা আনানোর ব্যবস্থাও করতে পারি, তাতে অনেকটা সময় লেগে যাবে।
ততক্ষণে ওই পাকিস্তানি সেনারা যে শেখ মুজিবের পরিবারের সদস্যদের জীবিত রাখবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। ফলে এটা পরিষ্কার ছিল, সময় হাতে খুব কম– এটি ধরে নিয়েই আমাকে যা সিদ্ধান্ত নেয়ার তা নিতে হবে।
কিন্তু মাত্র দুজন জওয়ানকে সঙ্গে নিয়ে ধানমণ্ডির ওই বাড়িতে অভিযান চালানো চরম নির্বুদ্ধিতা হতো। অতএব ওই সম্ভাবনা প্রথমেই খারিজ।
আমি তখন দেখলাম, এই পরিস্থিতিতে ‘সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার’ বা মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ চালানোই একমাত্র রাস্তা। শেখ মুজিবের পরিবারকে বাঁচাতে হলে সেই মুহূর্তে আমার সামনে আর কোনো পথও ছিল না।
আমি তখন আমার অস্ত্রটা দুই জওয়ানের কাছে জমা রেখেই খালি হাতে বাড়িটার দিকে এগোব বলে মনস্থ করলাম। আর ওদের বলে গেলাম, একদম আমাকে ফলো করবে না।
তার পর আমি ধীরে ধীরে বাড়িটার দিকে এগিয়ে সাংবাদিকের পড়ে থাকা লাশটা পেরোতেই জোরে চিৎকার করলাম, ‘কোই হ্যায়?’
কোনো জবাব এলো না। আর দু-এক পা এগোতেই আমি সশস্ত্র পাকিস্তানি সেনাদের পরিষ্কার দেখতে পেলাম, আবার একই প্রশ্ন করলাম। তার পরও সব চুপচাপ!
তখন একেবারে শামুকের গতিতে আমি বাড়ির গেটের দিকে এগোচ্ছি। যখন গেট থেকে মাত্র পাঁচ কি ছয় গজ দূরে, তখন একেবারে দেহাতি পাঞ্জাবিতে হুমকি এলো, আমি ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করলেই আমাকে গুলি করা হবে।
আমার নিজেরও মাতৃভাষা পাঞ্জাবি, আমি ওই কথা খুব ভালো করেই বুঝি। পরবর্তী কয়েক মিনিট ধরে আমাদের যা কথোপকথন, অতঃপর তার সবই হলো পাঞ্জাবিতেই।
আমি হুমকির জবাবে জানালাম, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কমান্ডাররা গতকালই আত্মসমর্পণ করেছে, কাজেই তারাও এখন অস্ত্র ফেলে দিলেই ভালো করবে।
মনে হলো ওই সেনাদের কাছে আত্মসমর্পণের কোনো খবরই পৌঁছায়নি। তারা আবার হুমকি দিল, ঢুকতে চেষ্টা করলেই আমাকে মেরে ফেলা হবে।
আমি তবু গেটের দিকে এগোচ্ছিলাম। একেবারে সামনে আসতেই গেটের যে সেন্ট্রি বা রক্ষী ছিল, সে তার বন্দুকের সামনে লাগানো ধারালো বেয়নেটটা আমার শরীরে ঠেকিয়ে ধরল। ছাদের ওপরে দাঁড়িয়ে থাকা জওয়ানরা আবারও হুমকি দিল।
আমি তখন বললাম, ‘দেখো, আমি ইন্ডিয়ান আর্মির একজন অফিসার। শহরের অন্য প্রান্ত থেকে একেবারে নিরস্ত্র অবস্থায় আমি একলা তোমাদের এখানে এসেছি- তার পরও কি তোমরা বুঝতে পারছ না সব খেলা চুকে গেছে? এখন আত্মসমর্পণ করা ছাড়া তোমাদের সামনে কোনো উপায় নেই।
এসব কথাবার্তা যখন হচ্ছে, তখনই আমার মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেল ভারতীয় বিমানবাহিনীর একটা হেলিকপ্টার।
আমি সঙ্গে সঙ্গে সেদিকে আঙুল তুলে বললাম, তোমরা কি ওই হেলিকপ্টারটা দেখতে পাচ্ছ? বুঝতে পারছ কী ঢাকার নিয়ন্ত্রণ এখন কাদের হাতে?
তারা সেদিকে দেখল ঠিকই, কিন্তু তার পরও খুব কঠিন গলায় বলল– ‘ওসব আমরা কিছু জানিটানি না। তুমি এখান থেকে দূর হঠো, ভেতরে ঢুকতে এলে আমরা কিন্তু গুলি করতে বাধ্য হব।’
কিন্তু আমি তখন আস্তে আস্তে বুঝতে পারছি, মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধে আমি ওদের ওপর ‘আপারহ্যান্ড’ পেতে শুরু করেছি। কারণ ওদের একজন এ কথাও বলল, ‘আমরা আগে আমাদের সিনিয়রদের সঙ্গে কথা বলব’।
আমার নিজের বিশ্বাস ছিল, এই পাকিস্তানি জওয়ানদের আর কয়েক মিনিটের জন্যও ভরসা করা যাবে না। কারণ তারা ক্রমশ বেপরোয়া ও একরোখা হয়ে উঠছে– যে কোনো সময় যা কিছু করে ফেলতে পারে।
আমি এক সেকেন্ডও দেরি না করে সঙ্গে সঙ্গে বললাম, ‘তোমাদের সিনিয়র অফিসাররা তো সবাই সারেন্ডার করেছেন। কথা বলবে কার সঙ্গে? আর তা ছাড়া বাড়ির টেলিফোন লাইনও কাটা, কথা বলবেই বা কীভাবে?’
‘তোমরা যদি এক্ষুণি সারেন্ডার না করো, মুক্তি বাহিনীর লোকজন আর ভারতীয় সেনাদের হাতেই তোমাদের প্রাণ যাবে।
‘ওদিকে পাকিস্তানে তোমাদের পরিবারের লোকজন, বউ-বাচ্চারা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। তোমরা কি চাও না আবার তোমাদের দেখা হোক, না কি ওরা তোমাদের লাশ ফিরে পাক?
ওরা তবু আত্মসমর্পণে রাজি হতে গড়িমসি করতে থাকে। কিন্তু কথার সুরে আর ধরনে বুঝতে পারি, তাদের প্রতিরোধ ক্রমশ দুর্বল হতে শুরু করেছে।
আমি তখন বারবার ওই কথাটাতেই জোর দিতে থাকি, নিজেদের স্ত্রী-সন্তানদের সঙ্গে দেখা করতে চাইলে এটিই তোমাদের শেষ সুযোগ!
‘এখনই সারেন্ডার করলে আমি ভারতীয় সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে তোমাদের কথা দিচ্ছি, অক্ষত শরীরে তোমরা নিজেদের হেডকোয়ার্টাসে ফিরে যেতে পারবে। আর না করলে তোমাদের লাশের যে কী হবে, তার কিন্তু কোনো গ্যারান্টি নেই।
এসব কথাবার্তা যখন চলছে, তখন গেটের সামনে রাইফেল ধরে-থাকা সেন্ট্রি ছেলেটার হাত-পা কিন্তু ঠকঠক করে কাঁপতে শুরু করেছে।
মাত্র আঠারো-উনিশ বছর বয়স হবে পাকিস্তানি ছেলেটার, চোখের সামনে আর রাইফেলের দূরত্বে একজন ভারতীয় সেনা অফিসারকে দেখে ভয় আর উত্তেজনা সামলাতে পারছিল না ও।
ওর বেয়নেটটা আমার শরীর স্পর্শ করে ছিল। কাঁপতে কাঁপতে ওর ট্রিগারে না চাপ পড়ে যায়, সেটা ভেবেই আমি হাত দিয়ে রাইফেলটা ধরে একটু ঠেলে আমার দিক থেকে পিছিয়ে দিলাম।
আর এসবের মধ্যেই নিজেদের মধ্যে কী সব কথাবার্তা বলে ধানমণ্ডির ওই বাড়িতে ওই ডজনখানেক পাকিস্তানি সৈন্য অবশেষে আত্মসমর্পণ করতে রাজি হয়ে গেল।
গেটের মুখে তো একটা বালির বস্তা দিয়ে তৈরি বাঙ্কার ছিলই, পঞ্চাশ গজ দূরে ছাদের ওপরের বাঙ্কার থেকেও এতক্ষণ আমার দিকে রাইফেল উঁচিয়ে ছিল ওরা। ওরা সবাই নেমে আসার পর দেখি বাড়ির একেবারে সামনে আর একটা বাঙ্কার।
ওরা এসে একে একে ওদের লাইট মেশিনগান ও অটোমেটিক ওয়েপেনগুলো জমা করল।
সব অস্ত্র ছিল লোডেড, মানে গুলি ভরা। মনে মনে একবার ভাবলাম, এগুলো দিয়ে গুলি ছুড়লে নিরস্ত্র আমি তো কিছু্ই করতে পারতাম না!
তার পর যে রকম কথা ছিল, আমি আমার দুই জওয়ানকে ডেকে পাঠালাম আর বললাম এই নিরস্ত্র পাকিস্তানি সৈন্যদের সোজা ড্রাইভ করে হেডকোয়ার্টার্সে নিয়ে যেতে।
আমাদের গাড়িতে কতগুলো সাদা পোশাকও (সিভিলিয়ান ড্রেস) পরে ছিল, ওই সেনাদের বলা হলো ওগুলো পরে নিতে- যাতে রাস্তায় কেউ পাকিস্তানি সেনা বলে চিনতে পেরে কোনো রকম হামলা না করতে পারে।
এর পর আমি গিয়ে বাড়ির মূল দরজাটা খুলে ভেতরে ঢুকতে না ঢুকতেই এগিয়ে এলেন বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী শেখ ফজিলাতুন্নেসা।
তারা এতক্ষণ ভেতর থেকে আমাদের সব কথাবার্তাই শুনতে পাচ্ছিলেন। আমার কোনো পরিচয়ও দেয়ার দরকার হলো না, বুকভরা অবেগেই তারা যেন আমায় ভাসিয়ে নিয়ে গেলেন।
ওই বাড়িতে অবরুদ্ধদের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী ছাড়াও ছিলেন তার কন্যা ও বাংলাদেশের আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আর কোলে তার মাত্র তিন মাসের শিশুপুত্র। ছেলেকে কোলে নিয়ে সেই প্রথম আমি শেখ হাসিনাকে দেখলাম।
পাশে ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ছোট মেয়ে শেখ রেহানাও। আরও ছিলেন পরিবারের দুজন অতিথিও। ফৌজি উর্দিতেও আমিও ততক্ষণে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ছি।
এদিকে ততক্ষণে বাড়ির বাইরেও ভিড় জমতে শুরু করেছে। বঙ্গবন্ধুর এক কাজিন, নাম সম্ভবত খোকা, এগিয়ে এসে আমাকে বললেন– ধানমণ্ডির বাড়ির ছাদে তখনও কিন্তু বাঁশে বাঁধা পাকিস্তানি পতাকা উড়ছে।
ওই খোকাই আমাকে একটা বাংলাদেশি পতাকাও এনে দিলেন। আমি সঙ্গে সঙ্গে তরতর করে ছাদে গিয়ে বাঁশ থেকে পাকিস্তানি পতাকাটা নামিয়ে ছুড়ে দিলাম নিচে, টাঙিয়ে দিলাম বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা।