উচ্চ শিক্ষায় মাতৃভাষার গুরুত্ব

লেখক: নুরুল করিম রাসেল
প্রকাশ: ৪ years ago

ড. আবু বিন ইহ্সান : প্রেম-ভালোবাসার বিশালত্ব বা পরিধি এতোটাই ব্যাপক, যার রসায়ন নিয়ে গবেষণা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। একে অপরের সঙ্গে বন্ধনে থাকার ভূমিকার জন্য অক্সিটোসিন নামক হরমোন যেটি ‘ভালবাসার হরমোন’ হিসেবে পরিচিত। ২০১১ সালে ডাচ গবেষকদের এক আকর্ষণীয় গবেষণার ফলে দেখা গেছে, অক্সিটোসিনের সঙ্গে দেশপ্রেম জড়িত (Proceedings of the National Academy of Sciences, 2011)| । তাই আমরা অক্সিটোসিনকে ‘দেশপ্রেমের হরমোন’ বলতে পারি! শ্রদ্ধা ও বিশ্বাসে সমৃদ্ধ শুদ্ধ ভালবাসাই আমাদের প্রকৃত দেশপ্রেমিক হতে সাহায্য করে। যা একই সূত্রে গাথা!

মাতৃভূমির মাটি ও মানুষের প্রতি ভালোবাসা মানুষের স্বাভাবিক ও সহজাত প্রবৃত্তি হলেও জাতি হিসেবে আমাদের দেশপ্রেম বিশ্বের বুকে ঈর্ষণীয় পর্যায়ের এবং দৃষ্টান্তমূলক। আমরা এমন জাতি, যারা মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার দাবিতে জীবন উৎসর্গ করেছি ও স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুত্থান ঘটিয়েছি। আমরা গর্বের সঙ্গে বলতে পারি, রাষ্ট্রসংঘের সাংস্কৃতিক সংস্থা ১৯৯৯ সালের ১৭ই নভেম্বর ২১শে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে এবং পরের বছর ২০০০ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি এই দিনটিকে মর্যাদা দিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এই দিনটিকে ‘মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে পালন করে। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষাভাষীর বিচারে স্প্যানিশ, চীনা ও ইংরেজির ভাষার পর বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ভাষায় কথা বলা বাংলা ভাষাকে ২০১০ সালে ইউনেস্কো বিশ্বের সবচেয়ে মধুরতম ভাষা হিসেবেও স্বীকৃতি দিয়েছে। পশ্চিম আফ্রিকায় আটলান্টিক মহাসাগরের উপকূলে অবস্থিত সিয়েরা লিওন প্রজাতন্ত্র বাংলা ভাষাকে তাদের দেশে দ্বিতীয় ভাষার মর্যাদা দিয়েছে।

দুঃখজনক হলো, অর্থনৈতিক উন্নতির নতুন সোপানে পা বাড়িয়েও বর্তমান সময়ে আমাদের ব্যথিত চিত্তে ভাবতে হচ্ছে এতো ত্যাগের বিনিময়ে আমরা যে

মাতৃভাষা পেলাম, আমরা কি তার প্রকৃত মর্যাদা দিচ্ছি? তরুণ প্রজন্ম কি বাংলা ভাষার প্রতি উদাসীন? নিজস্ব ভাষাপ্রেমের ঘাটতি দেখা যাচ্ছে কি? মানবপ্রেম বা দেশপ্রেমের ঘাটতি কেন এখন আমাদের সমাজে? অনিয়ম ও দুর্নীতি, তথা জনসাধারণের প্রতি ভালোবাসার অভাব কি আমাদের দেশের এখন প্রধান সমস্যা নয়? ভাষার প্রতি অবহেলা আর দেশপ্রেমের শঙ্কট কি এক সূত্রে গাঁথা? আমরা কি ভালোবাসায় প্রয়োজনীয়তা খুঁজে বেড়াচ্ছি না? পারস্পরিক বিশ্বাসের অভাবে যেমন দুজনার ভালোবাসায় দুর্বলতা থাকে, আদর্শিক মিলের অভাবে যেমন করে ভালবাসা শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে না, আমাদের চারপাশের অনিয়মের ও বৈষম্যের কারণে কি আমাদের দেশের প্রতি অনাস্থা অনুভূত হচ্ছে না?

মানুষের জ্ঞান, যোগ্যতা আর অভিব্যক্তি প্রকাশে যেহেতু ভাষার কোনো বিকল্প নেই, সুতরাং শক্তিশালী ভাষাসমূহ আমাদের দক্ষতার সঙ্গে আয়ত্বে থাকা উচিত। নিবিড়তার যোগসূত্র ভাষা; যে যত ভাষা শিখতে পারব, ভিন দেশের শিল্প-সংস্কৃতির সঙ্গে আরো বেশি নিবিড় হতে পারবো। আজকের দিনে একটি ভাষা নয়, একাধিক ভাষা আয়ত্ব করা বৈশ্বিকতার জন্যেও জরুরি। বিশ্বের প্রায় সকল দেশই বর্তমানে তাদের ‘দ্বিতীয় ভাষা’ হিসাবে ইংরেজির ব্যবহার করে থাকে। সে হিসাবে ইংরেজি কিংবা ভিন্ন ভাষা শেখা অবশ্যই দরকার, তবে বাংলার গুরুত্ব সর্বোচ্চ রেখেই। নিজের ভাষা প্রাণের ভাষা, এই ভাষায়ই একমাত্র প্রকৃত আনন্দ বুঝতে পারা যায়। যদি স্বদেশী ভাষায় পাঠ সহজ হয়, তবে সেই ভাষাটির মাধ্যমে পড়াশোনার গভীরে যাওয়া যায়। পড়াশুনা সত্যিকারভাবে হৃদয়ঙ্গম করতে হলে, সৃজনশীলতা অথবা মেধাবিকাশের জন্য মাতৃভাষায় পড়ার গুরুত্ব অপরিহার্য। আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন যে বাংলাভাষায় দক্ষতা অর্জন করে সঙ্গে যদি অন্য কোনো ভাষায় দক্ষতা অর্জন করতে পারি, আমাদের জন্য সেটাই হবে গৌরবের।

জাপান সরকারের ‘জাপান সোসাইটি ফর দা প্রমোশন অফ সায়েন্স’- এর নিমন্ত্রণে ২৫ জানুয়ারি সেখানকার একটা সিনিয়র হাইস্কুলে গিয়েছিলাম ‘দ্বিতীয় ভাষা’ হিসাবে ইংরেজির ব্যবহার ও বিজ্ঞান শিক্ষার আগ্রহ বাড়ানোর জন্য ছাত্রছাত্রীদের অনুপ্রাণিত করতে। দীর্ঘ একঘণ্টা পঞ্চাশ মিনিট লেকচার দেওয়ার পূর্বে তাদের ইংরেজি শিক্ষকের সঙ্গে পূর্ণভাবে ভাব বিনিময়ের জন্য জাপানিজ-ইংরেজি মিশিয়ে কথা বলার সময় জাপানের প্রচলিত কৌতুকটির কথা মনে পড়ছিল‘জাপানিজ ইংলিশ টিচার ক্যান নট স্পিক ইংলিশ!’

জাপানিজদের নিজ ভাষা ও দেশপ্রেম অতুলনীয়; তাদের সাফল্যের মূলমন্ত্র। অতি প্রয়োজন ছাড়া জাপানিরা ইংরেজি বা অন্য ভাষায় কথা বলে না। জাপানে শিক্ষা ব্যবস্থায় কেউ যদি ইংরেজি নাও জানে সে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারে। কারণ, এ দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা এমনভাবে সাজানো যে বিজ্ঞানসহ অনেক কঠিন বিষয়গুলো তারা বইয়ের ভাষায় সহজ করে দিয়েছে। বিশ্বে প্রয়োজনীয় কোনো বই প্রকাশের পর ন্যূনতম সময়ের মধ্যেই নিজ ভাষায় সহজ করে অনুবাদ করে নেন এখানকার শিক্ষাবিদ ও ভাষাবিদরা। অনেক ইংরেজি বলতে না পারা জাপানি অধ্যাপককেও দেখা যায় নিজের গবেষণা ও জ্ঞানের পরিধিতে অনেক এগিয়ে। কারণ এরা যা শিখেন, যা লিখেন তা নিজের ভাষায়; লেখাপড়া করার দরকারি সকল বই মাতৃভাষায় লিখে নিয়েছেন।

নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি প্রতি জাপানিদের প্রেম দেখে আফসোস হয়, এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল আমাদের। প্রাণের বিনিময়ে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পাওয়ার পর, দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও, বাংলা সর্বস্তরে চালু হয় নি আজও।

আমাদের প্রিয় ভাষা আন্দোলনের মূল প্রত্যাশা ছিল, বাংলা ভাষার মাধ্যমে সর্বস্তরে শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা। অথচ শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে সর্বস্তরে সেই ভাষা নেই। স্বদেশী ভাষায় ও শিক্ষায় যে বিষয়গুলো বোধগম্য হয় সেই বিষয়গুলো অন্যান্য তুলনামূলক কম বোঝা যায় একথা জানার পরও কেন আমাদের উচ্চশিক্ষার পরিভাষা মাতৃভাষায় হয় না? কেন আমরা বাংলা ভাষায় পাঠ চর্চা করতে পারি না? আমরা বাংলা মাধ্যমের ইংরেজি ভার্সন শুরু করেছি। আমরা কি উল্টো পথে হাটছি, আমাদের শিক্ষাবিদরা একটু ভেবে দেখবেন কি? এটা কারও ব্যক্তিগত সমস্যা নয়, আমাদের সমাজিক ও জাতীয় সমস্যা। সমাধানের জন্য আমাদের প্রত্যেকের সহযোগী হাত সরকারকে করতে পারে আরও বেশি শক্তিশালী। মাত্র কয়েক দশকে নিজ ভাষায় বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি চর্চা করে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিধ্বস্ত জাপান আজ উন্নয়নের শিখরে; জাপান সফলতার সাথে সর্বস্তরে

মাতৃভাষা প্রচলন করে সৎসাহস দেখিয়েছে, সফল হয়েছে! পৃথিবীতে যতগুলো দেশ উন্নত ও স্বনির্ভর হয়েছে, প্রতিটি দেশই মাতৃভাষাকে ভালোবেসে, সর্বস্তরে প্রচলন করেই বড় হয়েছে।

আমাদের উচ্চশিক্ষালয়ে বাংলা ভাষার প্রভাব এখনো খুবই কম। তবে আশার কথা হলো, দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষা ইনস্টিটিউট কিংবা ভাষা বিভাগ রয়েছে, বাংলা একাডেমির নিজস্ব গবেষণাকেন্দ্রও রয়েছে। এখানে যে গবেষণা হয়, তা মূলত ভৌত কিংবা বাংলা সাহিত্যে সীমাবদ্ধ। নিজের দেশের ভাষায় যে অলংকরণ প্রয়োজন, তা উপলব্ধি করে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানের ভাষাগুলো আরও বেশি করে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। দেশের ভবিষৎ প্রজন্মের কথা বিবেচনা করে আমরা বাংলা ভাষাকে ‘শিক্ষা’ গ্রহণের মাধ্যম হিসেবে গড়ে তুলতে চিন্তা করতে পারি। আমাদের উচিত হবে শুধুমাত্র ভাষাগত সাহিত্য চর্চা নয়, বিজ্ঞানের চর্চাকে আরো বেশি আকর্ষণীয় করে তোলা। শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান পাঠে আগ্রহী করে তুলতে হলে আমাদের দরকার বিজ্ঞানে বাংলা ভাষার শব্দভাণ্ডারকে উন্নত করা। বিজ্ঞানের পরিভাষাগুলাকে আমাদের মাতৃভাষায় রূপ দেওয়া। আর এ কাজের জন্য দেশের ভাষাবিদ ও শিক্ষাবিদদের এগিয়ে আসা দরকার। সরকারকে হতে হবে গতিশীল। আর সরকারের সুচিন্তিত পরিকল্পনা ও উদ্যোগ গ্রহনের মাধ্যমে আমাদের মাতৃভাষাকে আমরা অবশ্যই আরো বেশি সমৃদ্ধ করতে পারি।

লেখক ফার্মাসিস্ট ও গবেষক, তয়ামা প্রিফেকচারাল ইউনিভার্সিটি, জাপান

ilincon@gmail.com