এ.এন.এম. সিরাজুল ইসলাম : ইহুদীরা হাইকালে মুসলিম উত্তরাধিকার স্বীকার করে না। তারা হাইকালকে ইহুদী ধর্মের আলোকে পুনঃ নির্মাণ করতে চায়। তাদের ধারণা ইসলামের পূর্বে হাইকালকে ২ বার ভাঙ্গা হয়েছে। তাই এখন তাদের ৩য় হাইকাল নির্মাণ করতে হবে। তাদের আরো ধারণ, অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের হাতে পড়ে হাইকালের বহু বিকৃতি ঘটেছে, সে বিকৃতি দূর করা প্রয়োজন। বিন গুরিয়ন ও মানাচেম বেগিন বলেছেন, জেরুসালেম ছাড়া ইসরাইলের কোন মূল্য নেই এবং হাইকাল ছাড়া জেরুসালেমের কোন অর্থ নেই। এটা এখন ইসরাইলের জাতীয় শ্লোগান হিসেবে পরিণত হয়েছে। বর্তমান যুগের ইহুদীরা ইসরাইলের জাতীয় পতাকায় হাইকালকে ছয় তারকা বিশিষ্ট প্রতিকের মর্যাদা দিয়েছে। এটা তাদের কাছে দাউদ তারকা নামে পরিচিত। ইসরাইলী পতাকার মাঝখানে ঐ প্রতীক অবস্থান করছে। তাদের গাড়ী, বিমান ট্যাংক ও ক্ষেপনাস্ত্রের মধ্যে ঐ প্রতীক বিরাজ করছে। তাদের মতে হযরত দাউদ আলাইহিস সালাম হচ্ছেন ইসরাইল রাষ্ট্রের প্রথম প্রতিষ্ঠাতা। অথচ তারা এর আগে ইয়াকুবকে আলাইহিস সালাম ইসরাইল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা বলেছিল। ইসরাইলের লিখিত কোন সংবিধান নেই। তাদের সর্বোচ্চ সংবিধান হচ্ছে তাওরাত। এই দৃষ্টিতে তাদের রাষ্ট্রটি হচ্ছে একটি ধর্মীয় রাষ্ট্র। আরো বেশি আরব মুসলিম রাষ্ট্র গ্রাস করার লক্ষ্যে তারা এখন পর্যন্ত ইসরাইল রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক সীমানা ঘোষণা করেনি। তারা তাওরাতের বর্ণিত বৃহত্তর ভূ-খণ্ডকেই নিজেদের রাষ্ট্রের সীমানা মনে করে। ইহুদীরা তাদের ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেই কথা বলছে। যদিও তাদের মধ্যে উন্নত চারিত্রিক গুণ নেই। বাতিল ও বিকৃত ধর্মে সেরূপ চারিত্রিক গুণাবলী কিভাবে আসতে পারে? এখন আমরা হাইকাল সম্পর্কে ইহুদীদের অতীত ও বর্তমান চিন্তার উৎসসমূহ সম্পর্কে আলোচনা করবো।
১. তাওরাতে হাইকাল। তাওরাতের ১ম অধ্যায়ে সৃষ্টি পর্যায়ে, আল্লাহর ওয়াদার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ তাতে ইবরাহীমকে আলাইহিস সালাম বলেছেন, ‘আমি তোমার বংশধরকে এই যমীন দান করবো। অথচ ইহুদীরা ভুলে গেছে, ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর বংশের ইসমাঈল শাখাও রয়েছে। তাই বনি ইসমাঈল আল্লাহর ঐ ওয়াদার অংশীদার। মুসলমান হচ্ছে ইসমাঈলের আলাইহিস সালাম বংশধর! তাওরাত ইয়াকুব আলাইহিস সালাম সম্পর্কে বলছে, তুমি বাইতে ইলে যাও এবং সেখান বাস কর। সেখানে তুমি তোমার রবের উদ্দেশ্যে একটি জবেহর স্থান তৈরি কর।’ বাইতে ইল বলতে বাইতুল মাকদিসকে বুঝানো হয়েছে। ইউসুফ আলাইহিস সালাম সম্পর্কে তাওরাতের বক্তব্য হল, ইউসুফ আলাইহিস সালাম-এর হাড়গোড় মিসর থেকে জেরুসালেমে নিয়ে আসা হয়েছে। তাওরাত মূসা আলাইহিস সালাম সম্পর্কে বলে ? মূসা আলাইহিস সালাম ফেরাউনকে বলেছেন, আমার জাতিকে ছেড়ে দাও। ফেরাউন বলেছে, আমি তাদেরকে ছাড়বো না। হযরত মূসার আলাইহিস সালাম উদ্দেশ্য ছিল, বনি ইসরাইল জেরুসালেমের পবিত্র স্থানে এসে ইবাদাত করবে। তাওরাত মূসা আলাইহিস সালাম-এর পরবর্তী নবী ইউশা বিন নূনের আলোচনা প্রসঙ্গে বলেছে, আল্লাহ তাঁকে জেরুসালেমের দেয়াল ডিঙ্গিয়ে ভিতরে প্রবেশের নির্দেশ দিয়েছেন এবং তীহ ময়দানে অবস্থানরত ইহুদীদেরকে নিয়ে অভিযানের হুকুম দেন। এইভাবে তাওরাত বনি ইসরাইলের নবীদের সাথে জেরুসালেম নগরীর সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করেছে। তারপর হযরত দাউদ এবং সুলাইমান আলাইহিস সালাম এর সোনালী যুগ নিয়েও আলোচনা করেছে। জেরুসালেমের পবিত্র স্থান সম্পর্কে ইহুদীরা তাওরাত থেকে যে রকম প্রেরণা পায়, ঠিক সে ধরনের প্রেরণা খৃস্টানদের মাঝেও রয়েছে। কেননা ইহুদীদের মত তাওরাত এবং ইঞ্জিল তাদেরও পবিত্র কিতাব।
২. তালমুদে হাইকাল। তালমুদ হচ্ছে তাওরাতের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ। এটি ২০ খণ্ডে বিভক্ত বিরাট বই। তাই এটিও ইহুদীদের কাছে পবিত্র ধর্ম গ্রন্থ এবং ক্ষেত্র বিশেষে তা তাওরাত থেকেও বেশি পবিত্র বলে বিবেচিত হয়। হাখামাত ইহুদীরা ৪শ’ থেকে ৬শ’ খৃস্টাব্দে এই গোপন কিতাবটি রচনা করে। এই কিতাব ইহুদীদের চিন্তা পরিকল্পনার উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। এটি তাওরাতের ব্যাখ্যা হওয়ার কারণে তাতে পবিত্র স্থান এবং হাইকাল সম্পর্কে ব্যাপক আলোচনা স্থান পেয়েছে। তালমুদে বহু ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। তবে তাতে সর্বদাই অতিরিক্ত বক্তব্য রয়েছে এবং আলোচনায় বাড়াবাড়ি করা হয়েছে। মূল তাওরাত বিকৃত হওয়ার কারণে তার ব্যাখ্যা অবিকৃত হওয়ার প্রশ্নই ওঠেনা। তালমুদ বলেছে, ফিলিস্তিনের মাটি পবিত্র। বনি ইসরাইলের নেককার লোকদের সেখানেই দাফন করা উচিত। যদি তা সম্ভব না হয় তাহলে, কাফনের সাথে সেখানকার কিছু মাটি দেয়া উচিত।
৩. হাইকাল এবং ইহুদী পণ্ডিতদের তৈরি প্রটোকল ইহুদীদের এই প্রটোকলটি এমন একটি বই যা বিশ্ব ইহুদী রাষ্ট্রের কল্পিত সীমানা অংকন করেছে। এই বই অনুযায়ী জেরুসালেম থেকে হযরত দাউদ আলাইহিস সালাম-এর বংশধরগণ, গোটা বিশ্ব শাসন করবে। ১৮৯৭ খৃঃ সুইজারল্যান্ডের বেল শহরে আধুনিক যায়নবাদের প্রবক্তা থিওডোর হারজালের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত প্রথম আন্তর্জাতিক ইহুদী সম্মেলনে ইহুদী নেতৃবৃন্দ ২৪টি প্রটোকল তৈরি করে। ঐ সম্মেলনে ৫০টি ইহুদী সংগঠনের বিরাট সংখ্যক ইহুদী চিন্ত বিদ ও দার্শনিক অংশ নেয়। তখন থেকে তারা প্রতিবছর ১ বার আন্তর্জাতিক ইহুদী সম্মেলন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যা আজ পর্যন্ত অব্যাহত আছে। ইহুদী প্রটোকলটি তাদের কাছে আধুনিক ইহুদী চিন্তাধারার উৎস বলে বিবেচিত হয়। তৃতীয় প্রটোকলে উল্লেখ করা হয়েছে, “আমাদের উদ্দেশ্যের পথে যে কোন অন্তরায়কে আমরা চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেবো। আমরা আম্বিয়ায়ে কেরামের শরীয়তে দেখতে পাই যে, আল্লাহ আমাদেরকে তার যমীনে শাসন করার জন্য বাছাই করেছেন এবং তিনি আমাদরেকে সেই যোগ্যতা ও প্রজ্ঞা দান করেছেন। আমরা যখন সক্ষম হবো, তখন গোটা বিশ্ব শাসন করবো এবং তখন আমাদের ধর্ম ছাড়া আর কোন ধর্মকে সহ্য করবো না।” তাওরাত ও তালমুদ অনুযায়ী হাইকাল তৈরির পর তারা জেরুসালেম থেকে গোটা বিশ্বকে শাসন করার জন্য একজন শাসকের অপেক্ষা করছে।
৪. যায়নবাদ ও হাইকাল ইহুদী প্রটোকল অনুযায়ী আন্তর্জাতিক ইহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য যে কার্যকর আন্দোলন গড়ে উঠেছে, তাকে আধুনিক যায়নবাদ আন্দোলন বলা হয়। এই আন্দোলনটি জেরুসালেম ও হাইকাল পুনঃনির্মাণ সম্পর্কে কর্মসূচী দিয়ে থাকে। যায়নবাদের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে, এটি ইহুদীদের একটি ধর্মীয় ও রাজনৈতিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলন।
ইহুদী বিশ্বকোষে যায়নবাদের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, ইন্দীরা নিজেদের ঐক্য প্রতিষ্ঠা, জেরুসালেমে আগমন, শত্রুদের উপর বিজয়, মসজিদে আকসার বদলে হাইকাল নির্মাণ এবং সেখানে উপাসনা করতে চায়। ইতিমধ্যে ইহুদীরা যায়নবাদী আন্দোলনের ঘোষিত লক্ষ্যসমূহের কয়েকটি অর্জন করতে সফল হয়েছে। তারা ফিলিস্তিনে ফিরে এসেছে ও সেখানে ইসরাইল নামক ইহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছে এবং জেরুসালেমকে ইসরাইলের রাজধানী ঘোষণা করেছে। এখন তারা তাদের পরবর্তী পদক্ষেপ ইহুদী কিবলা বা ৩য় হাইকাল নির্মাণের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে।
সেজন্য তাদের সামনে মুসলমানদের ১ম কিবলা মসজিদে আকসা ভাংগার অপেক্ষা ছাড়া আর কিছু বাকী নেই। প্রথম ইহুদী প্রধানমন্ত্রী বিন গুরিয়ন বলেছেন, ‘আমরা সামিয়কভাবে তলোয়ার খাপবদ্ধ রেখেছি। আমাদের জাতীয় স্বাধীনতা বিপন্ন হলে আমরা অবশ্যই তলোয়ার ধারণ করবো। ইহুদী জাতি নীলনদ থেকে ফোরাত নদী পর্যন্ত বিস্তৃত নিজ বাপ-দাদার ভূমিতে বসতি স্থাপন করবে।”
৫. হাইকাল ও ফ্রি ম্যাসন আন্দোলন ইংল্যান্ডের প্রাচ্যবিদ ডোজির মতে, ফ্রি ম্যাসন আন্দোলন বলতে বুঝায়, একটি বিশেষ লক্ষ্যে পৌছার জন্য বিভিন্ন মত ও পথের বহু লোকের একসাথে কাজ করা। আর সেই কাজটি হচ্ছে, ইসরাইলের প্রতীক হাইকাল পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। ইংরেজীতে Free Mason শব্দের অর্থ হল, স্বাধীন রাজমিস্ত্রী। অর্থাৎ তারা কথিত হাইকাল তৈরির জন্য স্বাধীন রাজমিস্ত্রী। ফ্রি ম্যাসন আন্দোলনের শুরুতেই হাইকালে সুলাইমানী প্রতিষ্ঠার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয় এবং ইহুদীবাদ বিরোধী যে কোন ধর্ম ও মতবাদকে উৎখাত করার দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করা হয়। যাতে করে ইহুদীরা গোটা বিশ্বের নেতৃত্ব হাতে নিতে পারে। যায়নবাদের পরেই এই আন্দোলনের মর্যাদা হচ্ছে দ্বিতীয়। এগুলোর মাধ্যমে সম্প্রসারণবাদী ইহুদীরা নিজেদের ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করতে চায়। ফ্রি ম্যাসন আন্দোলন কাজের জন্য বিভিন্ন কৌশল গ্রহণ করে থাকে। তারা রোটারী ক্লাব, লায়ন্স ক্লাব, বার্থ ম্যাসন, ইউনিয়ন এন্ড ডেভেলপমেন্ট, ইয়াহওয়া উইটনেস, বাহাই ইত্যাদি ছদ্মনামে নিজেদের কাজ করে থাকে। ১৯৫৬ খৃঃ ফ্রান্সে তাদের এক আনুষ্ঠানিক ইশতেহারে বলা হয়, আমরা ম্যাসন, আমরা অন্যান্য ধর্মের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ক্ষান্ত হতে পারি না। যুদ্ধে হয় আমরা জয়ী হবো, নয় তারা। হয় তারা মরবে, নচেত আমরা মরবো। সকল ইবাদতগাহ বন্ধের আগ পর্যন্ত আমরা আরাম পাবো না।