অতিমাত্রায় ভেজালে ভরা প্রশাসন

: হুমায়ুন রশিদ
প্রকাশ: ২ years ago

বিএম জাহাঙ্গীর : বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় আছে। শুরু ২০০৯। পার হতে চলেছে ১৪ বছর। একেবারে কম সময় নয়। ক্ষমতা গ্রহণের পর ১৫ বছর শেষে পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে। কিন্তু সরকারের এই সময়কালে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনেকে নিজেকে শুধু সেরা আওয়ামী লীগার বানাতেই ব্যস্ত। আওয়ামীপন্থি প্রমাণ করার জন্য সুযোগসন্ধানীরা সম্ভব সবই করেছে। বসে থাকেনি ক্যারিয়ারিস্টরাও। বঙ্গবন্ধু আর জয় বাংলা বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলে ফেলেছেন। কেউ কেউ ব্যস্ত নকল করে বই আর কবিতা লেখায়। যাদের খাওয়া শেষ হয়নি, তাদের তোষামোদীর তোষণ নীতি এখনো বিরতিহীন। বিনিময়ে যে যেভাবে পেরেছেন দিনশেষে নিজের সুবিধা বাগিয়ে নিয়েছেন। আর বদনাম যা হওয়ার সব সরকারের। সরকারি দল আওয়ামী লীগের। কিন্তু সত্যিকারার্থে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করতে পারেননি অনেকে। বঙ্গবন্ধু তার জীবদ্দশায় সরকারি কর্মকর্তাদের উদ্দেশে দেওয়া বক্তৃতায় যে ঐতিহাসিক নির্দেশনা দিয়ে গেছেন, তা কেউ মানেন না। আর মানবেন কীভাবে? জানলে কিংবা শুনলে তো মানার চেষ্টা করবেন। অনেকে তো ওই দুর্লভ বক্তব্যটি শোনার চেষ্টাও করেননি। শুধু আমলা নন, এ সমাজের বহু পেশার অনেক ধড়িবাজও একই পথ অনুসরণ করে নিজের স্বার্থসিদ্ধি করেছেন। অথচ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর এসব চাটুকার কিংবা ওনাদের পূর্বপুরুষদের প্রায় সবাই নিশ্চুপ ছিলেন। এখন সুসময়ে আম-দুধ মাখিয়ে ক্ষমতার পুরো স্বাদ পেতে চেতনায় সব অজ্ঞান অবস্থা। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে এদের চরম আঘাত করতেন। যে আঘাতের কথা তিনি তার অসীম সাহসের বক্তৃতায় বলে গেছেন।

প্রশাসনের নব্য চেতনাবাজদের এ রকম বীভৎস চেহারা দেখে বড়ই আক্ষেপ করে ভেজালবিরোধী অভিযানে বিশেষ সাফল্য অর্জনকারী একজন কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, ‘শুধু ভেজাল পণ্যের বিরুদ্ধে মোবাইল কোর্টের অভিযান চালালে হবে না। প্রশাসনের মধ্যেও যে অতিমাত্রায় ভেজাল ঢুকে পড়েছে, সেখানেও অভিযান চালাতে হবে।’ অপর একজন কর্মকর্তা এ বিষয়ে তার ফেসবুক পেজে বিস্তর লিখেছেন। কিন্তু এখানে সেটি লিখলে তার ক্ষতি করে দিতে পারে বলে সেদিকে আর গেলাম না।

গত ১৬ অক্টোবর তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মকবুল হোসেন এবং ১৮ অক্টোবর পুলিশের এসপি পদমর্যাদার ৩ কর্মকর্তা সিআইডিতে কর্মরত মীর্জা আবদুল্লাহেল বাকী ও দেলোয়ার হোসেন মিয়া এবং পুলিশ সদর দপ্তরের পুলিশ সুপার (টিআর) মুহম্মদ শহীদুল্লাহ চৌধুরীকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর পর এখন প্রশাসনের সদর অন্দরের নানা খবর চাউর হচ্ছে। আকাশে-বাতাসে ঘুরছে অনেক প্রশ্ন এবং নানা শঙ্কার কথা। পেশাদার ও ত্যাগী আওয়ামী কর্মকর্তাদের অনেকে মুখ খুলতে শুরু করেছেন। নিজের আমলনামা দেখে অনেকে এখন খুবই বিচলিত। বাধ্যতামূলক অবসরে যাওয়ার শঙ্কা নিয়েও বড্ড উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় আছেন তারা।

প্রশাসনে কর্মরত পেশাদার আমলাদের অনেকে যুগান্তরকে জানিয়েছেন, আসলে প্রশাসনসহ পুরো সমাজের মধ্যে যে ভেজাল অবস্থা বিরাজ করছে, সেটাকে আগে ভেজালমুক্ত করতে হবে। তাহলে খাদ্যপণ্যসহ সবকিছুই রাতারাতি ঠিক হয়ে যাবে। তা না হলে সুবিধাবাদীরা মূলত তিনটি লক্ষ্য সামনে নিয়ে স্বার্থের বৈতরণি পার হতেই থাকবে। প্রথমত, যেভাবে হোক সময়মতো পদোন্নতিসহ বেতনের বাইরে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা কামানো যাবে-এমন সব গুরুত্বপূর্ণ পদে পোস্টিং তাদের চাই-ই। দ্বিতীয়ত, চাকরি থাকাবস্থায় পুরো পরিবারের পাসপোর্টে নিদেনপক্ষে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়ার ভিসা লাগানো। আর কত দ্রুত স্ত্রী-সন্তানদের বিদেশে পাঠানো যায়, সেই চেষ্টা করা। ওনাদের সন্তানের যেন বিদেশে পড়তেই হবে। না হলে খুবই গুনাহের কাজ হবে। এরপর বিভিন্ন ফর্মুলায় ঘুসের টাকা সেখানে পাচার করা। নামে-বেনামে বিদেশে সম্পদ গড়ে তোলা। ক্ষমতার অপব্যবহার করে গোপনে পিআর নেওয়া। এছাড়া আমলারা যে অর্থ পাচারে এগিয়ে, সেটি আমার বানানো কোনো কথা নয়। ২০২০ সালের ১৮ নভেম্বর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে আয়োজিত মিট দ্য প্রেস অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন এ তথ্য দিয়েছেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমার ধারণা ছিল কানাডায় অর্থ পাচার করা রাজনীতিবিদের সংখ্যা বেশি হবে; কিন্তু আমার কাছে যে তথ্য এসেছে, যদিও সামগ্রিক তথ্য নয়, তবু সেটিতে আমি অবাক হয়েছি। সংখ্যার দিক থেকে আমাদের সরকারি কর্মচারীর বাড়িঘর সেখানে বেশি আছে এবং তাদের ছেলেমেয়েরা সেখানে থাকে।’ এরপর কী হয়েছে? কিছুই হয়নি। বিবিসি দুদক চেয়ারম্যানকে প্রশ্ন করেছিল-এখন কী করবেন? উত্তর দিয়েছিলেন, ‘মন্ত্রী তথ্য দিলে ব্যবস্থা নেব।’ বাকিটা আর বললাম না।

এদিকে দেশে সব খাওয়া শেষ হলে সরকারি কর্মকর্তাদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের স্বাদ নেওয়া কেন বাকি থাকবে? ব্যাচমেট কিংবা জুনিয়রদের হক নষ্ট করে ওটাও তাদের চাই। তাও আবার এক, দুবার না। সম্ভব হলে অনন্তকালের জন্য লিখে দেওয়া হোক মধুর হাঁড়ির মালিকানা। তৃতীয়ত, সরকারের বিপদ আঁচ করতে পারলে কিন্তু খবর আছে। গোপনে বিপরীত মেরুর সঙ্গে যোগাযোগ করতে এক মিনিটও সময় নেবে না। আর পরিস্থিতি বেশি খারাপ মনে হলে সমস্যা নেই, পাসপোর্টে তো ভিসা লাগানো আছে। কে আর নাগাল পায়। চিকিৎসার কথা বলে হলেও দ্রুত সটকে পড়বে। অনেকে এসব ব্যবস্থা আগে থেকে পাকাপোক্ত করে রেখেছেন। এই হলো প্রশাসনের আসল চেহারা। এটা গল্প নয়। কঠিন সত্য। প্রশাসনে সাংবাদিকতা করতে গিয়ে পেশাগত চোখে ২৩ বছর ধরে এ ধরনের বিচিত্র চরিত্রগুলো দেখে আসছি।

সংশ্লিষ্টরা জানান, এই ত্রিচরিত্রের বর্ণচোরা কর্মকর্তায় গোটা প্রশাসন এখন ঠাসা। কিন্তু অবস্থা এমন যে, তাদের ধরা যাবে না, ছোঁয়া যাবে না, বলা যাবে না কিছু। কারণ, তারাই নাকি সরকারকে টিকিয়ে রাখে। এরকম মেকি প্রভাব বিস্তারের খড়্গ শুধু প্রশাসনে নয়, সর্বত্র। একসময় রাজনীতি দ্বারা সবকিছু নিয়ন্ত্রিত হতো। এখন উলটো চিত্র। আর মন্ত্রীর মেরুদণ্ড যদি শক্ত না হয়, তাহলে তো কেল্লাফতে।

আরেকটা বিশেষ অহংকারের সংস্কৃতি প্রশাসনকে এখন আষ্টেপৃষ্ঠে ঘিরে ফেলেছে। সেটি হলো-বিশেষ পাওয়ার হাউজে পোস্টিং। কেউ কেউ বলে থাকেন ‘রেড জোন’ কিংবা ‘হট জোন’। কয়েকজন কর্মকর্তা আফসোস করে প্রতিবেদককে বলেন, ‘একসময়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ব্যাচমেট-রুমমেট এখন আর আমার ফোন ধরে না। ভাবখানা এমন-চিনতেই পারে না। অথচ ওরা ভুলে গেছে, কোথায় সেই শামসুল আলম, আর মতিন (সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার এপিএস)? তারাও একসময় বেশুমার ক্ষমতার দাপট দেখিয়েছিল। যারা ‘মিনি ক্যাবিনেট’ নামে পরিচিত ছিল। এছাড়া বহু ডাকসাইটে মন্ত্রী-আমলার স্থায়ী ঠিকানা তো এখন জেলখানা। কিন্তু বাস্তবতা হলো-বিপদে না পড়া পর্যন্ত কারও হুঁশ হবে না।’

এর বাইরে আরেকটি রোগ এখন প্রশাসনে মহামারিতে রূপ নিয়েছে। সেটি হলো-নিজের একটা বিশেষ অবস্থান জানান দেওয়ার অপসংস্কৃতি। সেবাপ্রার্থী কিংবা দর্শনার্থী সামনে গেলে প্রথমেই তাকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়, তার দাদা আওয়ামী লীগ করতেন। নানা তো আওয়ামী লীগ করে জীবনই দিয়েছেন। কিংবা শ্বশুর, ভাই এমনকি নিজের সম্পর্কে একটা ফিরিস্তি দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া হয় তাকে কিছুতেই কিছু করা যাবে না। তার অনেক ক্ষমতা। বড় স্যাররাও তাকে নিয়ে সহজে ঘাঁটতে চান না, প্রভৃতি। সম্প্রতি এমন একটা ঘটনা ঘটেছে গেল সপ্তাহে। একজন ইউএনওর কাছে নামজারি-সংক্রান্ত একটা অনিয়মের অভিযোগ নিয়ে জনৈক সেবাপ্রার্থী দেখা করতে গেলে তাকে প্রথমে বলা হয়, ‘আমার দাদা করত আওয়ামী লীগ, আর আমি করি হাই লীগ। আমার ওমুক উপজেলা চেয়ারম্যান। বুঝতেই তো পারছেন। আমি কোথা থেকে এসেছি।’ এই ইউএনও সাহেবের এমন আচরণ দেখে ভুক্তভোগী তো হতবাক। তিনি বুঝতে পারছিলেন না কোথায় এসেছেন। এটা কী কোনো হাইব্রিড নেতার দলীয় অফিস, না সরকারি কর্মকর্তার দপ্তর। অথচ ৩৩ ব্যাচের এ কর্মকর্তার চাকরির বয়স এখনো ৮ বছর পার হয়নি। যাই হোক, এ রকম ইউএনও কিংবা আমলার সংখ্যা এখন অনেক। যারা নিজেদের রাজা মনে করেন। আর জনগণকে মনে করেন, গোবেচারা প্রজা।

প্রশাসনে দলবাজি আর ডিগবাজির এমন বেহাল দশা দেখে বৃহস্পতিবার একজন অতিরিক্ত সচিব আক্ষেপ করে যুগান্তরকে বলেন, ‘চেয়ার যদি আমার ব্যবহার ও চরিত্র পরিবর্তন করে ফেলে, তাহলে ধরে নিতে হবে আমার নিজস্ব কোনো চরিত্র নেই এবং কখনো ছিল না। আমার সব শিক্ষাই ব্যর্থ। অবশ্যই এদের জন্য একদিন কঠিন বিপদ অপেক্ষা করবে।’

১৯৮৪ ব্যাচের সাবেক একজন সচিব বৃহস্পতিবার রাতে ফোন করে বলেন, ‘আমার ভাই আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ছিলেন। এটাই আমার বড় অপরাধ। এ কারণে বিএনপি সরকার আমাকে সর্বোচ্চ সংখ্যায় ৪ দফায় উপসিচব পদে পদোন্নতিবঞ্চিত করে ডাম্পিং করে রেখেছিল। অথচ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আমাকে (বন্ধু ও সিনিয়ররা) ‘ওরা’ মেইনস্ট্রিমে আসতেই দেয়নি। কোনোমতে নামকাওয়াস্তে সচিব করে ফেলে রাখা হয়। পরিকল্পনা কমিশনে সচিবের সামারি আমার নামে গেলেও এক রাতে তা পালটে যায়। এসব কি ভোলা যায়? কোথায় সেই অসীম ক্ষমতাধর নবরত্নরা? কোনো ক্ষমা নেই। এ জাতি তাদের কোনোদিন ক্ষমা করবে না। তিনি বলেন, ‘প্রশাসনকে শুরু থেকে হাতেগোনা এসব ‘মহাপণ্ডিতরা’ শেষ করে দিয়েছে। তারা ইচ্ছামতো তাদের ঘরানার ও পরিবারের লোকজনকে সচিব করেছে। অথচ তারা কোনোদিন আওয়ামী লীগের ছিল না। ডান-বাম থেকে আসারা বড় আওয়ামী লীগার বনে যায়। এখনো তাদের উত্তরসূরিরা বহাল তবিয়তে আছে। এমনকি ৮৫ ব্যাচসহ কয়েকটি ব্যাচে সচিব হওয়ার মতো আমাদের কিছু দক্ষ নারী অফিসারকেও ওরা সচিব করেনি। ইতি রাণী পোদ্দার ও আলম আরার মতো অনেক দক্ষ কর্মকর্তা সচিব হতে পারেননি। এছাড়া বহু পেশাদার ভালো কর্মকর্তাকে পদোন্নতিবঞ্চিত করা হয়েছে। যার সব দোষ হয়েছে আওয়ামী লীগের। অথচ প্রধানমন্ত্রী জানতেই পারেননি। বোঝানো হয়েছে এরা আমাদের লোক না। আসলে বাস্তবতা হলো-ওনারা পছন্দ করেন না।

তিনি বলেন, ‘যেদিন মোল্লা ওহেদুজ্জামানকে ওই অফিস থেকে এবং সচিবালয় থেকে আবু আলম স্যারকে সরানো হলো, সেদিনই বুঝে গিয়েছিলাম আমাদের আর মূল্যায়ন হবে না। প্রশাসনে ঢুকে পড়া হাইব্রিডদের রাজস্ব চলবে।’ তিনি বলেন, ‘অথচ আমরাই চেয়েছিলাম-বিএনপি যে ভুল করেছে, আমরা আওয়ামী লীগকে সে ভুল করতে দেব না। অন্তত যারা একেবারে দলবাজি করেন না; কিন্তু মেধাবী ও পেশাদার, তাদের মূল্যায়নের ব্যবস্থা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারকে অসীম ইমেজের উচ্চতায় নিয়ে যাব। কারণ, প্রশাসন নিরপেক্ষ না হলে গণতন্ত্র ও রাজনীতি কখনো শক্তিশালী হবে না। তাদের ধারণা ছিল, আওয়ামী লীগ ভালোভাবে দেশ চালাতে পারলে বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া এই দলকে মানুষ এমনিতে ভোট দেবে। কিন্তু শুরুতেই কিছু চাটুকার ও রং লাগানো অতি আওয়ামী লীগাররা সেটি নষ্ট করে দিয়েছে।’

কয়েকজন কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, ‘ওরা শুধু জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে সুবিধা নিচ্ছে। কিন্তু জয় বাংলার জন্য কোনোদিন জীবন দেবে না। তারা তো ক্যারিয়ারিস্ট। তাদের কাছে আসলে চেতনার চেয়ে ক্যারিয়ার বড়। ওরা যখন বুঝতে পারে-বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে পারছে না, তখন জনতার মঞ্চ করেছিল। যাদের অনেক ছিল সুবিধাবাদী। ঘনঘন পান্ডা গার্ডেনে মিটিং করতেন। আবার ২০০১ সালেও একই চিত্র দেখেছে দেশবাসী। যখন বুঝেছে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসতে পারছেন না, তখন ছাতাটা ৩৬০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে রাতারাতি ঘুরিয়ে দিয়েছে। ওয়ান-ইলেভেন সরকারের শেষদিকে ২০০৮ সালের নির্বাচনে যখন কর্মকর্তারা বুঝতে পারছিলেন, আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় আসা শুধু সময়ের ব্যাপার মাত্র, ভোটের রাত পোহালে আওয়ামী লীগ বিপুল বিজয়ে ক্ষমতায় আসবে, তখনই রাতারাতি পালটে গেল সব। এরপর অবস্থা এমন হলো-চিরুনি অভিযান করেও একটা বিএনপি-জামায়াত খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হলো। রাতারাতি অনেকের হয় শ্বশুর আওয়ামী লীগ নেতা, না হয় ভাই, শালা- মামাতো ভাই, চাচাতো ভাই কিংবা ভাবখানা এমন যে, বাদশাহ আকবরের সময় থেকে তার পূর্বপুরুষরাও আওয়ামী লীগ করতেন। বোঝানো হলো-এতদিন ভয়ে বলতে পারেননি। হায়রে প্রশাসন! স্যালুকাস। আবারও বলছি, এ চিত্র শুধু প্রশাসনে নয়, সবখানে।

এর আগে বিএনপিকে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে ২০০৬ সালের ২৪ নভেম্বর উত্তরায় আর্টিসান ভবনে আমলারা এক গ্রুপ মিটিং করেছিল, যা প্রশাসনের ইতিহাসে ‘উত্তরা ষড়যন্ত্র’ নামে পরিচিত। যদিও ওই দলবাজ পণ্ডিতরা ঘটনার দিন মিডিয়ার কাছে ধরা খেয়েছিল। তাদের নিজেদের লোকই গোপন মিটিংয়ের কথা ফাঁস করে দিয়েছিল। আসল সত্য কথা হলো-মিটিংটা পণ্ড করে দিয়েছিলেন আবু আলম শহিদ খান। তিনিই প্রথম জানতে পারেন এবং সাংবাদিকদের খবর দেন। অব দ্য রেকর্ড রাখলাম না। সত্য ইতিহাসটা জাতি জানুক। যদিও আবু আলমও আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনতে ১৯৯৬ সালে জনতার মঞ্চের সামনের সারিতে ছিলেন। সবই সুশাসনপরিপন্থি চরিত্র। তবু আবু আলম ছিলেন মন্দের ভালো। সবাই জানে, তিনি প্রশাসনে একটা সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সুরক্ষা করতে চেয়েছিলেন। কাউকে খুশি করার জন্য নয়। এটা সত্য। বলতেই হবে।

আসলে কোনো গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে আমলাদের রক্ত দেওয়ার তেমন ইতিহাস নেই। রাজপথে শুধু সাধারণ মানুষ, রাজনৈতিক কর্মী, ছাত্র-জনতা রক্ত ও জীবন দিয়েছে। কোনো সরকারি কর্মকর্তা কিংবা তার সন্তানের জীবন দেওয়ার নজির খুবই কম। কিন্তু যখন কোনো সরকার গঠন হয়, তখন রাতারাতি ক্ষমতার সব লাগাম চলে যায় তাদের হাতে। সেবক না হয়ে তারা শাসকের দণ্ড হাতে দিয়ে শোষণ করার নীতি গ্রহণ করেন। আর সুযোগ পেলে ক্ষমতার অপব্যবহার করে ভয় দেখিয়ে সত্য প্রতিবাদ থামিয়ে দিতে চান। বাস্তবে এরা হলেন দল এবং দেশের বোঝা।

এদিকে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর সুবিধাবাদীরা বুঝতে পারছিলেন, এখন জয় বাংলা বেশি বললে বেশি সুবিধা নেওয়া যাবে। ঠিক ঘটলও তাই। তখন একযোগে সবাই আওয়ামী লীগার হওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েন। ঘনঘন বঙ্গবন্ধুর মাজার জিয়ারত শুরু হলো দলবেঁধে। কিন্তু সুবিধা নেওয়া শেষ হলে আর তারা ওমুখো হবে না। পদোন্নতি হওয়ার পর দলবেঁধে বঙ্গবন্ধুর মাজার জিয়ারত করে ফেসবুকে ছবি পোস্ট করার তীব্র প্রতিযোগিতা জাতিকে প্রত্যক্ষ করতে হলো। কিন্তু এর মধ্যে যারা অবসরে গিয়েছেন, তারা এখন আর টুঙ্গিপাড়া যান না। এটাই হলো তাদের আসল চেহারা। আর ফেসবুকে যা দেখেছি, সেটা ছিল মুখোশ।

কিন্তু চির সত্য হলো-সবার ওপরে রাজনীতি। রাজনীতি ও রাজনীতিবিদই শেষ কথা। আমলারা কখনো কাউকে ক্ষমতায় আনতে কিংবা রাখতে পারে না। এই মিথ্যা মিথ (ধারণা) ভেঙে চুরমার করে দিতে হবে। কিন্তু যদি রাজনীতিবিদদের ভুলে বিশেষ স্বার্থের জন্য কর্মচারীদের অপচেষ্টা করার সুযোগ কিংবা লাইসেন্স দেওয়া হয়, তাহলে দীর্ঘমেয়াদে রাজনীতি ও গণতন্ত্র এবং বিশেষ করে ওই দলটিকে চরম বিপদের দিকে ঠেলে দেয়। তাই দিনশেষে জনগণই হলো আসল শক্তি। এর বাইরে কিছু নেই। আর রাজনৈতিক দলের জন্য প্রয়োজন ত্যাগী ও আদর্শবান কর্মী। এরাই দলকে টিকিয়ে রাখে। শেষ পর্যন্ত কর্মীর কাছে নেতাকে ফিরে আসতেই হয়। কর্মী ছাড়া নেতা হয় না। কর্মীরাই নেতা-নেত্রী বানায়। কিন্তু কী দুর্ভাগ্য আজ! কোনো একজন এমপি তার নির্বাচনি এলাকায় সম্প্রতি বলেছেন, ‘ফুল ফুটিলে ভোমর আসিবেই। আমার কোনো কর্মী লাগবে না। নৌকা যখন পাব। তখন সব আমার পেছনে ছুটবে।’ আফসোস। এই হলো আমাদের মহান সংসদের জনপ্রতিনিধি।

যাই হোক, হতাশা ভালো কিছু আনবে না। সব সময় আশাবাদী হতে হবে। এত কিছুর পরও এখনো ভালো কর্মকর্তার সংখ্যা শেষ হয়ে যায়নি। প্রশাসনসহ সব সেক্টরে অনেক পেশাদার ভালো কর্মকর্তা আছেন। সম্প্রতি ইউটিউবে ভাইরাল হয়েছে গাজীপুরের চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. কায়সারুল ইসলামের আলোচিত একটি বক্তৃতা। তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের এডিদের এক সভায় বলেছেন, সংবিধানের ২১(১-২) পড়ে দেখুন। সেখানে আমাদের সম্পর্কে কী বলা আছে। জাস্ট পাবলিক সার্ভেন্ট। আর সার্ভেন্ট মানে তো বোঝেন। চাকর। অর্থাৎ, আমরা জনগণের চাকর। এটা কখনো ভুলে যাবেন না। সংবিধান হলো সুপ্রিম ল। এটা আমাদের মানতে হবে। লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। এই সত্য আমাদের মানতে হবে। হ্যাঁ, হতে পারে আপনার পদ বড়; কিন্তু নিজেকে কখনো বড় ভাববেন না। জনগণ যাতে আপনার ডেস্ক থেকে সেবা পায়, সেদিকে খেয়াল রাখবেন। বিনয়ী হোন। দেখবেন জীবনে সব পেয়ে গেছেন।

বঙ্গবন্ধুর সেই দুর্লভ ভাষণ : জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরকারি কর্মচারীদের উদ্দেশে তার এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘আপনি চাকরি করেন, আপনার মাইনা দেয় ওই গরিব কৃষক। আপনার মাইনা দেয় ওই গরিব শ্রমিক। আপনার সংসার চলে ওই টাকায়। আমি গাড়িতে চড়ি ওই টাকায়। ওদের সম্মান করে কথা বলেন। ওদের ইজ্জত করে কথা বলেন। ওরাই মালিক। এই বেটা, কোথা থেকে আসলি। সরকারি কর্মচারীদের বলব। মনে রেখো, এ স্বাধীন দেশ। ব্রিটিশ কলোনি নয়, পাকিস্তানি কলোনী নয়। যে লোকটাকে দেখবা, তার চেহারাটা তোমার বাবার মতো। তোমার ভাইয়ের মতো। ওরাই সম্মান বেশি পাবে। কারণ ওরা নিজে কামাই করে খায়।

একটা কথা জিজ্ঞাসা করি আপনাদের কাছে। মনে করবেন না কিছু। আপনাদের কাছে কেন? আমাদের কাছে জিজ্ঞাসা করি, কারণ আমিও তো আপনাদের একজন। বলেন, আমাদের লেখাপড়া শেখাইছে কেডা? আমরা বলি, আমার বাপ-মা। ডাক্তারি পাশ করায় কে? ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করায় কে? আজ বৈজ্ঞানিক করে কে? আজ অফিসার করে কে? কার টাকায়? বাংলার দুঃখী জনগণের টাকায়। আপনাদের কাছে আমার জিজ্ঞাসা, শিক্ষিত ভাইয়েরা-আপনার লেখাপড়ার খরচ যারা দিয়েছে, শুধু আপনার সংসার দেখার জন্য নয়, আপনার ছেলেমেয়ে দেখার জন্য নয়। দিয়েছে, তাদেরে আপনি কাজ করবেন, সেবা করবেন। তাদের আপনি কী দিয়েছেন? কী ফেরত দিচ্ছেন? কতটুকু দিচ্ছেন?

কার টাকায় ইঞ্জিনিয়ার সাব, কার টাকায় ডাক্তার সাব, কার টাকায় অফিসার সাব, কার টাকায় রাজনীতিবিদ সাব? কার টাকায় মেম্বর সাব? কার টাকায় সব সাব? সমাজ যেন ঘুণে ধরে গেছে। এ সমাজকে আমি চরম আঘাত করতে চাই। এ আঘাত করতে চাই, যে আঘাত করেছিলাম পাকিস্তানিদের। আমি আঘাত করতে চাই এই ঘুণে ধরা সমাজব্যবস্থাকে।’

বিএম জাহাঙ্গীর, উপসম্পাদক, দৈনিক যুগান্তর।